মাঝারি চেহারা। চশমা পরেন। হাতে বন্দুক নেয়ার থেকে দফতরের লেজার ব্যালেন্স মেলানোর কেরাণি হিসেবেই মানায় ভালো। এমনই মানুষ মিন অং লাইং। তিনিই মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের নায়ক। তার নির্দেশে ক্ষমতা হারিয়ে গৃহবন্দি আং সাং সু চি।
আপাতত এই ঠান্ডা গোছের কেরাণি বাবু চেহারার বর্মী সেনা প্রধানের নির্দেশে একদল বিশেষ রক্ষী সর্বক্ষণ সু চি কে ঘিরে রেখেছে। রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানে নোবেলজয়ী সু চি হারিয়েছেন মিয়ানমারের সর্বময় শাসকের তকমা। তার বদলে সেনাপ্রধান মিন অং লাইং এখন সর্বেসর্বা।
কেমন মানুষ বর্মী সেনার প্রধান?
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্মী সেনার প্রধানের নাগাল মেলা খুব কঠিন। বহু চেষ্টার পর ২০১৫ সালে অল্প সময়ের জন্য এই রহস্যময় ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করেছিলেন বিবিসি সংবাদদাতা জোনাহ ফিশার। গভীর রাতে সেনাপ্রধান মিন অং দেখা করেন।
বিবিসি সাংবাদিককে হাসিমুখে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন জেনারেল মিন অং লাইং। তবে তার প্রতিটা উত্তর ছিল কড়া ও ওজনদার। প্রতিবেদনে মিয়ানমারের এখনকার সেনা শাসকের সম্পর্কে বলা হয়েছে, বর্মী সেনার সুপ্রিমো মিন অং লাইং মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট হওয়ার বাসনা রাখেন। তিনি বিবিসিকে বলেছিলেন, যদি জনগণ তাকে বেছে নেন তাহলে তিনি সেই দায়িত্ব নেবেন।
জেনারেল মিন অং লাইং সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। এই বিষয়ে গোপনীয়তার নীতি অবলম্বন করে বর্মী সেনা। সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে বিবিসি জানিয়েছে, সেনা প্রশিক্ষণ নেয়ার সময় খুব চোখে পড়ার মত কেউ ছিলেন না তিনি। ইংয়াঙ্গন বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত আইন পড়েছিলেন। নিজেকে আড়ালে রাখতেই পছন্দ করতেন।
পদমর্যাদার ভিত্তিতে তিনি যখন বর্মী সেনার সর্বচ্চো পদে গেলেন তখন অনেকেই অবাক হন। তবে এর পরেই ছিল মিন অং লাইংয়ের ঠান্ডা মাথার কাজকর্মের পালা। মিয়ানমারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করতে নেত্রী আং সান সু চি যখন বিশ্বজুড়ে আলোচিত, তখন সবার অগোচরে সু চি কে সেনা ঘেরাটোপে রেখে দেয়ার পরিকল্পনা করছেন জেনারেল লাইং।
কেন এমন পরিস্থিতি? বিবিসি জানিয়েছে, ১৯৬২ সালের ২ মার্চ মিয়ানমারে সেনা সরকার ক্ষমতা দখল করেছিল। রক্তাক্ত পরিস্থিতি ছিল তখন। ১৯৯০ সালে তাদের নির্দেশে প্রথম নির্বাচন হয়েছিল। সেই নির্বাচনে সু চি’র দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি বিপুল জয়ী হয়। পরে ভোট বাতিল করে সেনা। গৃহবন্দি হন সু চি। ২০১০ সালে তিনি মুক্তি পান। ২০১১ সালে তিনি মুক্তি পান। নির্বাচিত হন বিপুল ভোটে।
টানা সেনা শাসনের সময়েই মিয়ানমারের সংবিধানে জাতীয় সংসদে ২৫ শতাংশ আসন সেনাবাহিনীর জন্য সংরক্ষণ করা হয়। এর অর্থ নির্বাচনে যাই হোক, সরকারকে চাপে রাখতে আইনসভায় সেনার প্রত্যক্ষ উপস্থিতি থাকবেই।
বিবিসি কে জেনারেল মিন অং লাইং জানিয়েছিলেন, দেশের রাজনীতির উপর সেনাবাহিনির নিয়ন্ত্রণ কমানোর কোনও ইচ্ছাই তার নেই। পার্লামেন্টে সেনাবাহিনীর ২৫ শতাংশ আসন এবং আং সান সুচির প্রেসিডেন্ট হবার ওপর সাংবিধানিক নিষেধাজ্ঞা পরিবর্তন করার বিষয়ে কোনও মন্তব্য তিনি করেননি।
সংবিধানের ধারা অনুযায়ী, বিদেশি বিয়ে করার কারণে সু চি প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। তবে তিনি ছিলেন মিয়ানমার সরকারের ডি ফ্যাক্টো প্রধান। এর অর্থ তিনি প্রেসিডেন্ট না হয়েও সর্বময় শাসক।
কিন্তু সেনাবাহিনী তার বিশ্ব জুড়া পরিচিতি নিয়ে তীব্র সন্দেহজনক অবস্থানে ছিল বরাবর। তাই সর্বময় নেত্রী হয়েও সু কি একরকম সেনার ঘেরাটোপেই ছিলেন। বিশেষ করে রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে যখন বিশ্বে আলোড়িত, তখন তার নীরবতা বলে দিয়েছিল তিনি কতটা অসহায়।
আপাতভাবে সেই অসহায়তার ইঙ্গিত এখন সত্যি। ঠান্ডা মাথার খুবই সাধারণ চেহারার সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং লাইংয়ের নির্দেশে বন্দি।