গত আগস্ট মাসে জ্বালানি তেলের দাম এক লাফে প্রায় ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি করার পর থেকেই লাফিয়ে বাড়তে শুরু করে নিত্যপয়োজনীয় বিভিন্ন দ্রব্যের মূল্য। সরকার পন্যের দাম না বাড়ালেও ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে দাম নিচ্ছেন অতিরিক্ত। আবার কোনো কোনো পণ্যের দাম সরকার যে পরিমান বৃদ্ধি করে, তার চেয়ে দ্বিগুন বা তিনগুন বাড়িয়ে বিক্রি করা হয় ক্রেতাদের কাছে। গত তিন মাসের বেশি সময় ধরে বাজারে চলছে এ অরাজকতা।
তবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যে বাজারের এই নৈরাজ্যের কোনো ছাপ নেই। সরকারি এ সংস্থাটির তথ্য বলছে, অক্টোবর মাসে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। নভেম্বর মাস শুরুর আগ পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৯১ শতাংশে। সেপ্টেম্বরে এ হার ছিল ৯ দশমিক ১০ ও আগস্টে ছিল ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ।
পরিসংখ্যান ব্যুরো এমন তথ্য জানালেও বাজারের তথ্য বলছে ভিন্ন কথা। নিত্যপণ্য গত বছরের এই সময়ের চেয়ে এখন বেশি দামে কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের। এমনকি সরকারের বিপণন সংস্থা টিসিবির তথ্যও বলছে, জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির হার অনেক বেশি। গত বছরের এই সময়ে খোলা আটা বিক্রি হতো ৩৩ টাকা কেজি। এখন সেই আটা ক্রেতাদের কিনতে হচ্ছে ৬০ থেকে ৬২ টাকা কেজি দরে।
সরকারের প্রতিষ্ঠান টিসিবির হিসাবে, গত এক বছরে খোলা আটার দাম কেজিতে বেড়েছে ৭৯ দশমিক ৪১ শতাংশ। এছাড়া ২০২১ সালের ১৮ নভেম্বর প্রতি কেজি প্যাকেট আটার দাম ছিল ৩৮ টাকা। ২০২২ সালের ১৮ নভেম্বর সেই আটা ক্রেতাদের কিনতে হচ্ছে ৭০ টাকা কেজি দরে। সরকারের হিসাবেই এই প্যাকেট আটার দাম বেড়েছে কেজিতে ৬৯ শতাংশের বেশি। টিসিবির তথ্য অনুযায়ী খোলা ময়দার দাম বেড়েছে ৫৩ শতাংশের বেশি। আর প্যাকেট ময়দার দাম কেজিতে বেড়েছে ৫৮ শতাংশের বেশি। শুধু তাই নয়, গত এক বছরে খোলা সয়াবিন তেলের দাম লিটারে বেড়েছে ২৮ শতাংশের বেশি। বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে ২০ শতাংশের বেশি। মসুর ডালের দাম কেজিতে বেড়েছে ৩০ শতাংশেরও বেশি। এমনকি রসুনের দাম কেজিতে বেড়েছে ৬০ শতাংশের মতো।
যদিও বিবিএসের হিসাবে, গত মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৮ শতাংশে। সেপ্টেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এর নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলছেন, বাস্তবে মূল্যস্ফীতি আরও বেশি, তবে কমিয়ে দেখানো হচ্ছে। বৃহস্পতিবার এক সেমিনারে তিনি বলেন, চলমান অর্থনৈতিক সংকটে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে স্বল্প আয়ের মানুষের প্রকৃত আয় কমে গেছে। তাদের খাদ্যতালিকা থেকে মাছ-মাংস বাদ দিতে হচ্ছে।
এদিকে বাজারের তথ্য বলছে, গত বছরের এই সময়ে এক কেজি দেশি শুকনো মরিচ কিনতে ক্রেতাদের খরচ হতো ১৬০ থেকে ১৮০ টাকা। এখন সেই মরিচ কিনতে হচ্ছে ৪০০ টাকা কেজি।
টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে দেশি শুকনো মরিচের দাম কেজিতে বেড়েছে ১২০ শতাংশের মতো। আর আমদানি করা শুকনো মরিচের দাম কেজিতে বেড়েছে ৭২ শতাংশ। গত বছরের এই সময়ে দেশি আদার দাম ছিল ১০০ টাকা কেজি। এখন সেই আদা ক্রেতাদের কিনতে হচ্ছে ২২০ টাকা কেজি দরে। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় এবার এই দেশি আদার দাম বেড়েছে ৯১ শতাংশ। আর ৭০ টাকা কেজি দরের আমদানি করা আদার দাম বেড়ে হয়েছে ১৫০ টাকা। টিসিবির হিসেবে গত এক বছরে এই পণ্যটির দাম বেড়েছে ৮৪ শতাংশ। ৩০০ টাকা কেজি দরের জিরা এখন দাম বেড়ে হয়েছে ৫০০ টাকা কেজি।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে ডলারের উচ্চ মূল্যের কারণে আমদানি পণ্যের দাম বেড়েছে। এরমধ্যে সরকার তেল ও চিনির দাম বৃহস্পতিবার নতুন করে নির্ধারণ করে দিলেও বাজারে এর চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। আর মৌসুম শেষে সরবরাহ কমতে থাকায় অব্যাহতভাবে বাড়ছে চালের দাম। যদিও টিসিবির হিসাবে গত এক বছরে সব ধরনের চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ৮ শতাংশের মতো। অবশ্য গত সপ্তাহের তুলনায় এই সপ্তাহে বাজারে মোটা চাল কেজিতে বেড়েছে ২ থেকে ৩ টাকা। প্রতি কেজি সাধারণ মানের পাইজাম বা মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৪ থেকে ৬০ টাকায়, যা গত সপ্তাহে ছিল ৫২ থেকে ৫৮ টাকা। আর মাঝারি মানের চাল কিনতে হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৫ টাকা ও ভালো মানের সরু চাল বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকার ওপরে।
এছাড়া গত সপ্তাহের তুলনায় এই সপ্তাহে প্যাকেট আটায় ৪ টাকা বেড়ে প্রতি কেজি ৭০ টাকায় ঠেকেছে। প্যাকেট ময়দায় দাম ১০ টাকা বেড়ে প্রতি কেজি ৮০ টাকা হয়েছে। খোলা আটা কেনা যাচ্ছে ৬৫ টাকায়, আর ময়দা ৭৫ টাকায়।এদিকে গত বৃহস্পতিবার সরকারিভাবে বোতলজাত প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম ১২ টাকা এবং প্যাকেটজাত চিনির দাম কেজিতে বাড়ানো হয়েছে ১৩ টাকা। তবে বাড়তি দামেও বাজারে মিলছে না তেল-চিনি। ক্রেতাদের কিনতে হচ্ছে এর চেয়েও বাড়তি দামে।
গতকাল রাজধানীর মিরপুর এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, খোলা বাজারে নির্ধারিত দাম থেকে ১০ টাকা বেশি এবং পাইকারি বাজারে ৩-৫ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে তেল-চিনি। আর রাজধানীর মানিকনগর এলাকায় খোলা সয়াবিন তেল পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে ১৮৮-১৯০ টাকায় এবং খুচরায় বিক্রি হচ্ছে ১৯৫-২০০ টাকায়। অন্যদিকে বোতলজাত সয়াবিন তেল গায়ে থাকা দামে বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে ২ লিটার ৩৫৫ টাকা এবং ৫ লিটার ৮৮০ টাকায় আগের দামে বিক্রি হচ্ছে। পাইকারিতে খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকা কেজি দরে। তবে খুচরায় অনেকে ১২০ টাকা কেজি দরেও বিক্রি করছেন।
এদিকে, বাজারে শীতকালীন সবজি পর্যাপ্ত এসেছে। দামও গত দুই সপ্তাহের তুলনায় কিছুটা কম। তবে কেজিপ্রতি ৫০ টাকার কমে মিলছে না কোনও সবজি। যা আগে ৬০ থেকে ৮০ টাকা ছিল। মুড়িকাটা পেঁয়াজ আসতে শুরু করায় আমদানি ও দেশি পেঁয়াজের দামও কমতে শুরু করেছে।বাজারে শীতকালীন সবজির দাম কমতে শুরু করেছে। ১২০ টাকার সিম কমে এখন ৫০ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে। গাজর ও পাকা টমেটোর কেজি ১০০ টাকা, পটল, করলা, বেগুন, লতির কেজি ৪০ থেকে ৫০ টাকা। ফুলকপি ও বাঁধাকপি প্রতি পিস ৩৫ থেকে ৪০ টাকা।
কয়েকদিন আগেও পেঁয়াজের দাম ৬০ টাকা ছিল। এখন ৫০ টাকার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া রসুন ও আদার দাম ২০ থেকে ৩০ টাকা কমেছে।রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়, সপ্তাহ খানেক আগে এর দাম ছিল ৬০ টাকা, আমদানি পেঁয়াজের কেজি মান ভেদে ৪০ থেকে ৫০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। যেগুলো গত সপ্তাহে বিক্রি হয়েছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়। দেশি রসুন কেজিতে ১০ টাকা কমে মান ভেদে ৭০ থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, গত সপ্তাহে ছিল ৮০ থেকে ১০০ টাকা, দেশি আদা বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২২০ টাকা, গত সপ্তাহে ছিল ২২০ থেকে ২৪০ টাকা।
বাজারে ব্রয়লার ১৭০ থেকে ১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চলতি মাসের শুরুতে প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছিল ১৮০ থেকে ১৯০ বা তারও বেশি দামে। সেই হিসাবে এই মাংসের দাম কমেছে ১০ টাকা। অন্যদিকে, বাজারে কমতে শুরু করেছে ফার্মের মুরগির ডিমের দাম। প্রতি হালি ডিম বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৪৫ টাকায়; যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ৫০ টাকা।
অন্যদিকে, গত এক মাসের বেশি সময় ধরে বেড়ে চলেছে প্রায় সব ধরনের ডালের দাম। নতুন করে বাড়ছে ছোলার দামও। খোলা বাজারে মসুর ডালের কেজি মান ভেদে ১১০ থেকে ১৪০ টাকা এবং ছোলার প্রতি কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে ৮৫ থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
মাছের বাজারে দেখা যায়, ছোট সাইজের পাঙাশ ১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাঝারি সাইজের পাঙাশ বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকা কেজিতে। এছাড়া বিলের পাঙাশ দাবি করা মাছগুলো বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা কেজি। চাষের কই প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকা, ছোট বোয়াল ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা, ছোট টেংরা ৪০০ টাকা, টাকি মাছ ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা, পাঙাশ মাছ ১৮০ থেকে ২০০ টাকা, রুই মাছ ৩০০ থেকে ৩৫০, কাতলা ২৮০ থেকে ৩২০ টাকা, পাবদা ৩০০ থেকে ৪৫০ টাকা, চিংড়ি ৫৫০ থেকে ৬৫০ টাকা, শোল মাছ ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা, সিং মাছ ৪৫০ টাকা, রূপ চাঁদা ছোট সাইজের প্রতি কেজি ৭৫০ টাকা, তেলাপিয়া ২২০ টাকা, ছোট কাচকি মাছ প্রতি কেজি ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা, এক কেজি ওজনের ইলিশ ১৩০০ থেকে ১৬০০ টাকা, দেড় কেজি ওজনের ইলিশ ১৮০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।