বাংলাদেশসহ পাঁচটি দেশ থেকে শিশু দত্তক নিতে গিয়ে নানা অনিয়মের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে -এমন প্রমাণ পাওয়ার পর নেদারল্যান্ডস সাময়িক সময়ের জন্য বিদেশ থেকে শিশু দত্তক নেওয়া পুরোপুরি স্থগিত করেছে। বাংলাদেশ থেকে শিশু দত্তক নেওয়ার আইনে যথেষ্ট কড়াকড়ি আছে।
যেসব নিঃসন্তান বিদেশি দম্পতি বাংলাদেশ থেকে শিশু দত্তক নিতে চান, তাদের কী প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হয়? ইউরোপের একটি দেশে অবস্থানরত এক দম্পতি বর্ণনা করেছেন তাদের অভিজ্ঞতা।
বেবি নাম্বার টু-টু-সিক্স:
বেবি নাম্বার টু-টু-সিক্স বা ২২৬ নম্বর শিশু। একটি সরকারি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে শিশুটিকে এই নামেই ডাকা হতো, কারণ তার আগের নাম-পরিচয় কারও জানা ছিল না।
বেবি নাম্বার টু-টু-সিক্সের এখন একটা নতুন নাম রাখা হয়েছে। কিন্তু তার নতুন নামটিও আমরা জানাতে পারছি না তার পরিচয় গোপন রাখার স্বার্থে।
মাত্র আড়াই বছর বয়সেই এই শিশুটির জীবনে অনেক নাটকীয় ঘটনা ঘটে। জন্মের পর তাকে পরিত্যাগ করা হয়েছিল। তারপর ঠাঁই হয়েছিল এক সরকারি হাসপাতালে। সেখান থেকে এক নিঃসন্তান দম্পতি তাকে নিয়ে এসেছে ইউরোপের এক দেশে।
বেবি নাম্বার টু-টু-সিক্সকে তার পালক মা প্রথম দেখেন বাংলাদেশ থেকে পাঠানো এক ছবিতে। শিশুটির ছোট্ট, অপুষ্ট, কিন্তু রক্তাক্ত দেহের ছবিটি শিউরে উঠার মতো।
‘ছবিটি দেখে আমি ধাক্কা খেয়েছিলাম। শিশুটির শারীরিক অবস্থা বিচলিত হওয়ার মতো। আমি নিউট্রিশন নিয়ে পড়াশোনা করেছি। অপুষ্টির শিকার শিশুদের ছবি আমি অনেকবার দেখেছি। কিন্তু তারপরও আমার মনে হলো, আমাকে এই শিশুটির কাছে যেতে হবে, আমি এই শিশুটিকেই চাই।’
বিয়ের পর থেকেই সন্তান নেয়ার চেষ্টা করছিলেন এই দম্পতি। কিন্তু শারীরিক সমস্যার কারণে পর পর পরপর পাঁচ বার মিসক্যারেজের শিকার হন স্ত্রী। তারপর থেকে চেষ্টা করছেন একটি শিশু দত্তক নেয়ার। বেবি নাম্বার টু-টু-সিক্সকে দেখে স্ত্রী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, তিনি বাংলাদেশে যাবেন এই শিশুকে আনতে।
‘তখন বেশ রাত। আমার স্বামী ঘুমিয়ে পড়েছেন। আমি ওর জন্য একটা কাগজে একটা নোট লিখলাম। আমি আমার স্বামীকে জানালাম, আমি এই শিশুটিকে দত্তক নিতে চাই। সামনের সপ্তাহেই বাংলাদেশে যেতে চাই।’
সত্যি সত্যি তিনি পরের সপ্তাহে তিনি বাংলাদেশে রওনা হয়েছিলেন শিশুটিকে আনার জন্য। কিন্তু তিনি যে দীর্ঘ এক আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে জড়িয়ে পড়তে যাচ্ছেন, সে সম্পর্কে কোন ধারণাই তার ছিল না।
‘আমি যখন রওনা দেই তখন জানতামই না যে আমি কিসের মধ্যে পড়তে যাচ্ছি। আমি আবেদন করবো আর ওরা বাচ্চাটা আমার কোলে তুলে দেবে, তারপর আমি তাকে বাড়ি নিয়ে আসবো, ব্যাপারটা যে মোটেই এরকম নয় তা আমি বুঝতেই পারিনি।’
দত্তক নেওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা:
নেদারল্যান্ডসের কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি যে পাঁচটি দেশ থেকে শিশু দত্তক নেয়া সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ করেছে তার একটি হচ্ছে বাংলাদেশ। ১৯৬৭ সাল হতে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত এসব দেশ থেকে যেসব শিশুকে দত্তক নেয়া হয়েছিল, সেখানে নাকি অনেক অনিয়ম হয়েছিল। এর মধ্যে ভুল তথ্য দেয়া, কাগজপত্র জালিয়াতি, এরকম অনেক অভিযোগ ছিল। এসব অভিযোগ তদন্তের পর কয়েকদিন আগে নেদারল্যান্ডসের সরকার এই সিদ্ধান্ত নেয়।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পরবর্তী বছরগুলোতে বাংলাদেশ থেকে প্রচুর শিশুকে বিদেশিরা দত্তক নিয়ে গিয়েছিল। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তখন বাংলাদেশে প্রচুর অভিভাবকহীন এতিম শিশু। পরিত্যক্ত শিশু। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এমন নারীদের গর্ভে জন্ম নেয়া যুদ্ধ-শিশু।
আইনজীবী শাহদিন মালিক জানান, এসব শিশুকে বিদেশিদের কাছে দত্তক দেয়ার জন্য তখন বিশেষ বিধানের আওতায় ব্যবস্থা করা হয়। প্রচুর শিশুকে তখন বিদেশিরা নিয়ে যায়।
নেদারল্যান্ডসে যেসব দত্তক নেয়া শিশুর বেলায় এরকম অনিয়ম দেখা গেছে, তার মধ্যে বাংলাদেশের এই সময়কালের কোন শিশু আছে কীনা তা পরিষ্কার নয়। তবে তখন আইন-কানুন অত কঠোর ছিল না। কিন্তু সাম্প্রতিক দশকগুলোতে বাংলাদেশে এ সংক্রান্ত আইন-কানুনে অনেক কড়াকড়ি করা হয়েছে।
আইনজীবী আমিরুল হক জানান, ১৯৮০ সালে এ সংক্রান্ত আইনে সংশোধনী এনে বাংলাদেশ থেকে বিদেশিদের শিশু দত্তক নেয়া বন্ধ করে দেয়া হয়।
বাংলাদেশ থেকে এখন আর বিদেশিরা শিশু দত্তক নিতে পারে না। তবে আইনগত অভিভাবক হতে পারেন। সেজন্যে এক জটিল প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে তাদের যেতে হয়। বেবি নাম্বার টু-টু-সিক্সের ক্ষেত্রে সেরকম জটিল আইনি প্রক্রিয়ারই মুখোমুখি হয়েছিলেন এই দম্পতি, এবং এজন্যে প্রায় দুবছর বাংলাদেশে কাটাতে হয়েছিল তাদের।
হাসপাতালে পরিত্যক্ত শিশু:
বেবি নাম্বার টু-টু-সিক্সকে পাওয়া গিয়েছিল বাংলাদেশের এক সরকারি হাসপাতালের বাইরে পরিত্যক্ত অবস্থায়। হাসপাতালের এক শিক্ষানবিশ চিকিৎসক তাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। নবজাতক শিশুটির শরীরে ছিল আঘাতের চিহ্ন। সাথে সাথে তাকে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে ভর্তি করা হয়।
শিশুটির জন্য নিরাপদ এক আশ্রয়ের কথা ভাবছিলেন সেই চিকিৎসক। তখন হঠাৎ তার মনে এসেছিল এই প্রবাসী নিঃসন্তান নারীর কথা, যিনি তাঁর আত্মীয়। তার কাছে ছবি পাঠালেন। জানালেন শিশুটির সার্বিক অবস্থার কথা।
‘সমস্ত যোগাযোগে যখন শিশুটিকে টু-টু-সিক্স নামে উল্লেখ করা হচ্ছে, সেটা একটা ধাক্কা দিয়েছিল আমাকে’, বলছিলেন এই নারী।
‘একটা বাচ্চা, একটা মানব সন্তান, তাকে কিভাবে টু-টু-সিক্স নামে ডাকা হয়। শিশুটিকে দেখার আগেই, এমনকি বাংলাদেশে পৌঁছানোর আগেই আমি প্লেনে বসে গুগলে নাম খুঁজতে থাকি। এমন একটা নাম, যেটা দিয়ে ওর ধর্ম, জাত কিছুই বোঝা যাবে না, একটা ইউনিভার্সাল নাম। তারপর আমি ঠিক করে ফেলি এরকম একটা নাম।’
পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া শিশুটির অবস্থা ছিল বেশ সংকটজনক। সরকারি হাসপাতালের যে ওয়ার্ডে তাকে রাখা হয়েছিল, সেখানে অনেক বিশৃঙ্খলা এবং অব্যবস্থাপনা। বাংলাদেশে পৌঁছেই এই হাসপাতালে ছুটে যান তিনি।
‘প্রথম যখন বাচ্চাটাকে দেখি, তখন ও ঘুমিয়ে। হঠাৎ শিশুটি জেগে উঠলো। আমার দিকে যেন ডাগর চোখে তাকিয়ে আছে। এই মূহুর্তটা আমি ভিডিও করে রেখেছি। এরপর আমি ওকে কোলে নেই। হঠাৎ আমার কান্না পেয়ে যায়, আমি হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করি। শিশুটি আমার জামার একটি অংশ খামচে ধরে রেখেছিল। আমি খুব বেশি ধার্মিক নই। কিন্তু সেই মূহুর্তে আমার মনে হয়েছিলো, এটি একটি ঐশ্বরিক ব্যাপার। এই শিশুটির সঙ্গেই হয়তো আমার নিয়তি জড়িয়ে আছে।’
কিন্তু বেবি নাম্বার টু-টু-সিক্সকে নিয়ে তখন অনেক জটিলতা। নানা শারীরিক সমস্যার জন্য তাকে দীর্ঘদিন হাসপাতালে রেখেই চিকিৎসা দিতে হবে। অন্যদিকে যেহেতু তাকে আহত এবং পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল, তাই এ নিয়ে পুলিশ মামলা করেছিল।
দীর্ঘ আইনি লড়াই:
টু-টু-সিক্সের আইনি অভিভাবক হওয়ার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন করলেন এই দম্পতি। ১৯৮০ সালের পর এক্ষেত্রে যে সরকারি নিয়ম করা হয়, তাতে বলা হয়েছে, কোন বাংলাদেশি শিশুর আইনি অভিভাবকত্ব পেতে হলে কোন দম্পতির অন্তত একজনকে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত হতে হবে।
এটি তাদের জন্য কোন সমস্যা হলো না। কারণ ইউরোপের একটি দেশের নাগরিক হলেও তারা দুজনেই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত।
আইনজীবী আমিরুল হক এধরনের অভিভাবকত্ব নিয়ে বেশ কিছু মামলায় আদালতে কাজ করেছেন। পুরো প্রক্রিয়াটি ব্যাখ্যা করছিলেন তিনি।
‘শুরুতেই যে দম্পতি কোন পরিত্যক্ত শিশুর দায়িত্ব নিতে চান তার জন্য বাংলাদেশের আদালতে অভিভাবকত্বের আবেদন করতে হবে। কোন পরিবার যদি তাদের শিশুর অভিভাবকত্ব ত্যাগ করে অন্য কারো কাছে অভিভাবকত্ব দিতে চান সেক্ষেত্রেও শিশুটিকে পরিত্যক্ত হিসেবে দেখানো হয়। আদালতে জেলা প্রশাসক সরকার পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেন। মামলার শুনানিতে আদালত যদি মনে করে যে এই দম্পতি শিশুটির মঙ্গলের জন্য অভিভাবক হওয়ার যোগ্য, তাহলে আদালত তাদের আইনি অভিভাবক হিসেবে নিয়োগ করে থাকেন।’ টু-টু-সিক্সকে পাওয়ার জন্য শুরু হলো এই দম্পতির আইনি লড়াই। সেটা খুব সহজ ছিল না। তাদের দৌড়াতে হচ্ছিল নানা জায়গায়, একবার থানায় পুলিশের কাছে, একবার আদালতে।
‘পুলিশি তদন্ত আর আদালতের শুনানিতে যে কত শতবার হাজিরা দিয়েছি তা হিসেব করে বলতে পারবো না।’
বেবি নম্বর টু-টু-সিক্স তখনো হাসপাতালে। তবে এই আইনি লড়াই চলাকালে তার অভিভাবকত্বের জন্য আবেদন করা এই নারীকে অনুমতি দেয়া হয় প্রতিদিন কিছু সময় হাসপাতালে শিশুটির পাশে কাটানোর।
‘পাঁচ মাস প্রতিদিন ওর বিছানার পাশে সকাল ৮টা হতে রাত ১২টা পর্যন্ত থাকার অনুমতি পেয়েছিলাম। আমি একটা চেয়ার পেতে বিছানার পাশে বসে থাকতাম। একটা ভাঙা বিছানা। এর মধ্যে মাত্র দুবার বোধহয় ওকে বারান্দায় নিয়ে যাওয়ার অনুমতি পেয়েছিলাম। হাসপাতালের এমন পরিবেশ, আওয়াজ, গন্ধ এসব কিছুর মধ্যে থাকতে থাকতে রাতে বাসায় ফিরে আমি আর ঘুমাতে পারতাম না।’
আনুষ্ঠানিক আবেদনের প্রায় চার মাস পর শেষ পর্যন্ত আদালত এই দম্পতিকে শিশুটির আইনি অভিভাবকত্ব দিয়েছিল। তবে তাদের আরও অনেক আইনি লড়াই তখনো বাকী। শিশুটিকে তারা বাংলাদেশের বাইরে নেয়ার অনুমতি তখনো পাননি। আর প্রতিমাসে শিশুটিকে নিয়ে তাদের আদালতে হাজিরা দিতে হবে।
‘শিশুটির যে দেশে জন্ম হয়েছে আমাদেরকে সেখানে থেকে প্রমাণ করতে হবে যে আমরা সকল আইন মান্য করছি এবং শিশুটির দায়িত্ব নিতে আমরা যোগ্য,’ বলছিলেন পালক মা।
এরপর তাকে প্রায় আরও ১৮ মাস বাংলাদেশে থাকতে হয় শিশুটির সঙ্গে। তার স্বামী ইউরোপে যাওয়া-আসার মধ্যে থাকতেন।
‘এরকম শিশুদের আইনি অভিভাবকত্ব পেলেও আদালতের অনুমতি ছাড়া তাদের বাংলাদেশের বাইরে নেয়া নিষেধ। সেজন্যে আলাদা আবেদন করতে হয়,’ বলছিলেন আইনজীবী আমিরুল হক। তিনি বলছেন, আদালত থেকে অনুমতি পাওয়া গেলে বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ সাধারণত এই বিষয়ে বাধা দেয় না।
অবশেষে বেবি নাম্বার টু-টু-সিক্সকে বিদেশে নেয়ার জন্য আবেদন করলেন তাদের আইনি অভিভাবক এই দম্পতি। এবার শুরু হলো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পাসপোর্ট অফিসে দৌড়াদৌড়ি।
‘বাচ্চাটার পাসপোর্ট করার সময় দেশ ছেড়ে যাবার জন্য আমাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে একটি এনওসি (অনাপত্তিপত্র) নিতে হয়েছে। এটার জন্যই আমাকে সবচাইতে বেশি ভুগতে হয়েছে। আমার বাচ্চার মতো এত জটিল ঘটনা ওরা কখনো পায়নি। ফেলে যাওয়া রক্তাক্ত বাচ্চা, যার বিষয়ে মামলা চলেছে, পুরো বিষয়টাই বেশ জটিল। কিছুতেই ওদের বিষয়টা বোঝাতে পারছিলাম না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তখন বিষয়টি যাচাই করার জন্য গোয়েন্দা বিভাগকে দায়িত্ব দেয়।’
পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ হাসপাতালের ঘটনা, মামলা, এই দম্পতির বিস্তারিত খবর নেবার পর যখন প্রতিবেদন দেয় তখন শেষ পর্যন্ত অনাপত্তিপত্র পাওয়া যায়।
অবশেষে একদিন শিশুটিকে নিয়ে তারা বাংলাদেশ ছেড়ে ইউরোপে চলে আসলেন।
‘ওই কয়টা মাস কি নিদারুণ সময় যে গেছে। অবশ্য আমি এখন যখন ফিরে তাকাই আমার কাছে হাসপাতালের সময়টাকেও মনে হয় যে এর চাইতে ভালো সময় আমার জীবনে আর আসেনি। আমি যেন এই শিশুটির জন্য ভাগ্য নির্ধারিত ছিলাম।’