ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঢাকা আসছেন। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ২৬ মার্চ দিল্লি থেকে ঢাকা এসে পৌঁছাবেন তিনি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উদযাপন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে তার এই সফর।
একইসাথে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কেরও ৫০ বছর এই ২০২১ সাল। তাই নরেন্দ্র মোদীর এই সফরকে ঘিরে আলাদা আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যেতে গত ২৯ জানুয়ারি এই সফর সম্পর্কিত এক বৈঠকে বসে দুই দেশের পররাষ্ট্র সচিব ও সংশ্লিষ্টরা।
এবারের সফর দুই দেশের জন্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ। কেননা সাম্প্রতিক সময়ে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নানা গুঞ্জনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এনআরসি ইস্যুতে নানামুখী বক্তব্য, বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের অতি তৎপরতা, চীনের সাথে বাংলাদেশের স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্ক, মহামারীর কারণে নরেন্দ্র মোদীর সফর স্থগিত সংক্রান্ত নানামুখী অপপ্রচার এসব কিছু মিলিয়ে কিছুটা অস্বস্তিকর সময় পার করেছে দুই দেশ। তবে দু’দেশই চাইছে বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক একটা নতুন উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত হোক। আর তাই কোভিড মোকাবিলায় সহযোগিতার পাশাপাশি বাণিজ্য, বিদ্যুৎ, শক্তি, জলসম্পদ ও অন্যান্য বহুমাত্রিক ক্ষেত্রগুলো নিয়ে দুই দেশের পররাষ্ট্র সচিব গত ২৯ জানুয়ারির মিটিংয়ে আলোচনা করেছেন। এবারের সফরে কি চমক থাকছে তা নিয়ে চারদিকে চলছে জল্পনা কল্পনা।
কেননা নরেন্দ্র মোদীর সফর মানেই যে বড় কোন চমক থাকে তার প্রমাণ এর আগের সফর। ২০১৫ সালের জুন মাসে নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশ সফরে আসলে ছিটমহল সমস্যা সমাধানের ঘোষণা দেয়া হয় এবং সে বছরের পহেলা আগস্টে তা সমাধানও করা হয়। দীর্ঘ ৬৮ বছর শোষণ, নির্যাতন এবং পরিচয়হীন এক জনগোষ্ঠীকে স্বাধীনতার আনন্দে উজ্জীবিত করা হয়েছিলো এই ঐতিহাসিক ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমে। তাই এবারের সফরের ক্ষেত্রেও এমন কোন ঘোষণার অপেক্ষায় বাংলাদেশ। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নানা মান অভিমান ও কণ্টকতা থাকে। যেহেতু বৃহত্তম স্থলসীমান্ত ভারত-বাংলাদেশের মাঝে রয়েছে তাই কিছু সমস্যা ও সাংঘর্ষিক অবস্থান থাকবেই। এটা শুধু ভারত- বাংলাদেশের ক্ষেত্রে না- যেকোন দেশের ক্ষেত্রেই এই সমস্যাগুলো থাকে।
বিগত ১০ বছরে এই সমস্যা কমেছে অনেক এবং বাকি অমীমাংসিত সমস্যাগুলোও আলোচনার মাধ্যমেই কমাতে হবে। এই সফরের আগেও সম্পর্ক উন্নয়নের পথে মূল বাধাগুলো চিহ্নিত করে তা সমাধানের পথে এগিয়ে যাচ্ছে দুই দেশ। এবারের সফরে প্রথাগত বিষয়ের পাশাপাশি নতুন কিছু সহযোগিতার বিষয় উঠে এসেছে বলে আমরা যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে জানতে পেরেছি। তিস্তা নদীর পানি বন্টন, স্থল সীমান্তের অমীমাংসিত বিষয়, অন্য নদীর পানি বন্টন, সীমান্ত সংক্রান্ত সমস্যাগুলো তো আছেই পাশাপাশি নতুন বেশ কিছু বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে যেমন কানেক্টিভিটি, ইনফরমেশন টেকনোলজি ও লাইন অব ক্রেডিটের গতি কীভাবে বাড়ানো যেতে পারে- এইসব বিষয়।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিয়ানমারের রাখাইনের বাস্তুচ্যূত রোহিঙ্গাদের জন্য রাখাইনে যথাযথ পরিবেশ তৈরি করে তাদের সেখানে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য ভারতের আরও সক্রিয়তার অনুরোধ করেছেন। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করে ভারত, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড হাইওয়েতে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির আনুষ্ঠানিক অনুরোধ সম্বলিত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর একটি চিঠি হস্তান্তর করেন পররাষ্ট্র সচিব।
এছাড়াও বাংলাদেশ সরকার বিদ্যুৎ বাণিজ্যের বিষয়টি নতুন করে ভাবছে। যেহেতু বিদ্যুৎ সক্ষমতা বাড়ছে, বড় বড় প্লান্টগুলো উৎপাদনে যাচ্ছে এবং শীঘ্রই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে যাবে তাই সরকার আগে থেকেই বিদ্যুৎ বাণিজ্যের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। তাছাড়া বাংলাদেশের কিছু বাণিজ্য ইস্যু রয়েছে। যেমন শুল্ক ও অশুল্ক বাধা। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখেছি পিঁয়াজ আমদানির ক্ষেত্রে হঠাৎ করেই বাধা আরোপ করা হয়েছে এবং এসব বাণিজ্য বাধার কারণে ব্যবসায়ীরা যেমন বিপাকে পড়েন তেমনি সাধারণ মানুষকেও কষ্ট ভোগ করতে হয়। এতে জনগণের মাঝে একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় যা দুই দেশের জনকেন্দ্রিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে চরম বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই এই সমস্যাগুলো সমাধানেও এবার তারা আলোচনা করেছে।
নরেন্দ্র মোদীর এই সফরকে কেন্দ্র করে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও উত্থাপন করেছে ঢাকা। নেপাল ও ভুটানের সাথে যোগাযোগ বাড়াতে ভারতের কাছ থেকে তাদের আরও নতুন ভূমি ও রেললাইন এবং স্থলবন্দর ব্যবহারের সুযোগ চেয়েছে বাংলাদেশ। দিল্লিতে দু’দেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকে দিল্লির কাছে এমন অনুরোধ তুলে ধরে ঢাকা। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ-ভারত-নেপাল-ভুটান আন্তঃদেশীয় রেল যোগাযোগ স্থাপনে একমত হয়েছিল। আর এবার ঢাকা দিল্লির কাছে অনুরোধ জানালো এই বাবদে ভারতকে নতুন ভূমি, রেললাইন ও স্থলবন্দর ব্যবহার করতে দিতে। এবারের সফরে তাই এই সংক্রান্ত বিষয়ে কোন ঘোষণা আসতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।
খুশির সংবাদ হলো, নরেন্দ্র মোদীর সফরের আগেই ৮ ফেব্রুয়ারি সোমবার বাংলাদেশ থেকে নেপালে ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে ভারত সরকার। বিবিআইএন (বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল সংযুক্তি) সংযোগ এবং উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার এক বিরাট অগ্রগতি হিসেবে বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার রহনপুর ও ভারতের সিঙ্গাবাদ রেলপথ দিয়ে বাংলাদেশ থেকে নেপালে সার রপ্তানিতে এ ট্রানজিট সুবিধা দিয়েছে ভারত। বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আমদানি করা সার নেপালে পাঠানো হচ্ছে। চলতি বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ রেলওয়ে নেপালে রপ্তানি করা সার বোঝাই প্রথম ট্রেনটি ভারতীয় রেলওয়ের কাছে হস্তান্তর করে। বর্তমান রেলওয়ে ট্রানজিট ব্যবহার করে প্রায় ২৭ হাজার মেট্রিক টন সার নেপালে রপ্তানি করা হবে।
১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ ও নেপালের মধ্যে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তির অধীনে বাংলাদেশ থেকে নেপালে পণ্য রপ্তানি করা হয় এবং অন্যান্য দেশ থেকে নেপালের আমদানি করা পণ্যগুলো ভারতীয় অঞ্চলের মধ্য দিয়ে ‘ট্রাফিক ইন ট্রানজিট’ হিসেবে পরিবহন করা হয়। নেপালের সঙ্গে রপ্তানি ও স্থল বাণিজ্যের জন্য ভারত বিশেষভাবে বাংলাদেশকে ট্রানজিট সুবিধা দিয়ে আসছে। তবে এই ট্রানজিটকে আরো সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে এবারের সফরে নতুন ঘোষণার অপেক্ষায় আছে বাংলাদেশ। আর এই ট্রানজিট বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশ-ভারত-নেপাল-ভুটান আন্তঃদেশীয় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এক মাইলফলক ঘটনা হবে।
এছাড়া ছয়টি অভিন্ন নদীর পানি বন্টনের বিষয়ে ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট চূড়ান্ত করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে এবারের সফরে। আশা করা হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোন ঘোষণা আসবে এই ছয় অভিন্ন নদীর পানি বন্টন বিষয়ে। কেননা অভিন্ন ছয় নদীর অর্থাৎ মনু, মুহুরী, খোয়াই, গোমতি, ধরলা এবং দুধকুমার নদীর পানি বন্টনের বিষয়ে অন্তর্বর্তী চুক্তির বিষয়ে ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি চূড়ান্ত করার বিষয় গত ডিসেম্বর মাসে নরেন্দ্র মোদী ও শেখ হাসিনার ভার্চুয়াল বৈঠকেও গুরুত্ব পেয়েছিলো। ছয় অভিন্ন নদীর পানিবন্টন সংক্রান্ত অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তির কাঠামোটির দ্রুত সমাপ্তির কথাও উল্লেখ করা হয়েছিল। এই অভিন্ন ছয় নদীর পানি বন্টনের বিষয়টি আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কেননা শুকনো মৌসুমে উজানে অর্থাৎ ভারত পানি প্রত্যাহার করে বলে দুই দেশের অভিন্ন নদীগুলোর বাংলাদেশ অংশে পানি যথেষ্ট কমে যায়। বর্ষায় পরিস্থিতি হয় উল্টো। বাংলাদেশের নদীগুলোতে অতিরিক্ত পানি থাকে। তখন উজান থেকে পানি ছাড়ার পরিণতিতে বাংলাদেশে বন্যা দেখা দেয়। এই সমস্যাকে সমাধানের পথে নিতে শেখ হাসিনা সরকারই প্রথম কার্যকরী আলোচনায় গিয়ে বাস্তব পরিণতির দিকে যাচ্ছে। চুক্তি অনুযায়ী সার্বিক কাজ শেষ করে খুব দ্রুতই এই সমস্যা থেকে উত্তরণ ঘটবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর এবারের ঢাকা সফরকে কেন্দ্র করে দুই দেশই চাইছে সর্বোচ্চ জায়গা থেকে অমীমাংসিত সমস্যার সমাধান করতে। গত কয়েক দশকে ভারত ও বাংলাদেশ আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাস, স্থলসীমা ও সমুদ্র সংশ্লিষ্ট বিরোধসহ বড় বড় বেশ কিছু বিষয়ে একমত হয়ে সমাধান করেছে। তবে পানিবন্টন, সীমান্ত হত্যা এবং রোহিঙ্গা শরণার্থী বিষয়ক সমস্যাসহ আরও বেশ কিছু ক্ষেত্রে দেশ দুটির পারস্পরিক সহযোগিতার সুযোগ রয়েছে। আর সেই সুযোগগুলোকে কাজে লাগিয়েই এই সম্পর্ককে দৃঢ় করতে চায় দুই দেশ। ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে গত ২৬ জানুয়ারি দিল্লিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১২২ জনের একটি দলের দৃষ্টিনন্দন কুচকাওয়াজ মৈত্রীর যে বার্তা দিয়েছে তা নিঃসন্দেহে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার ক্ষেত্রে এক ভিন্ন নজির।
তাছাড়া অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ভারত যেভাবে ঢাকায় বন্ধুত্বের স্মারক হিসেবে ২০ লক্ষ ডোজ কোভিড-ভ্যাকসিন পাঠিয়েছে তাও নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে ফার্স্ট প্রায়োরিটি নীতির বহিঃপ্রকাশ। তাই এবারের নরেন্দ্র মোদীর সফর যেনো ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে এক ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে যায় সে প্রত্যশায় সবাই।