প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ঢাকা শহরকে স্মার্ট সিটি হিসেবে গড়ে তুলব। সরকার জনগণের কল্যাণের কথা মাথায় রেখে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে।
আজ রোববার রাজধানীতে কালশী ফ্লাইওভার এবং ইসিবি স্কয়ার থেকে কালশী হয়ে মিরপুর পর্যন্ত ছয় লেনের সড়ক উদ্বোধনের পর তিনি এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ জীব বৈচিত্র্য ও চমৎকার সবুজে ভরা একটি দেশ। ফুল, ফল, পাখির অত্যন্ত সৌন্দর্য্যে ভরা এই দেশটিকে আমরা সেভাবেই গড়ে তুলব। পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন স্মার্ট বাংলাদেশ আমরা গড়ব এবং ঢাকা সিটিও স্মার্ট সিটি হবে। সেটাই আমাদের লক্ষ্য। আমরা সেজন্য বহু পদক্ষেপ নিচ্ছি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় আছি বলেই বাংলাদেশকে আজ উন্নত করতে পেরেছি। জাতির পিতার রোখে যাওয়া স্বল্পোন্নত দেশকে আমরা উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা এনে দিয়েছি এবং এ মর্যাদাকে ধরে রেখেই আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে। আগামীর বাংলাদেশ হবে ২০৪১ সালের উন্নত সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ।’
শেখ হাসিনা বলেন, ঢাকা শহরের প্রধান সমস্যা হল এর পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে ভালো সংযোগ না থাকা। তার সরকার রাজধানীর এই অংশে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে অগ্রাধিকার দিয়েছে।
তিনি বলেন, ইসিবি স্কোয়ার থেকে ২ দশমিক ৩৪ কিলোমিটার কালশী ফ্লাইওভার এবং ৩ দশমিক ৭০ কিলোমিটার প্রশস্ত ও ছয় লেনের রাস্তা মিরপুর, ডিওএইচএস, পল্লবী, কালশী, মহাখালী, মানিকদি, মাটিকাটা, ভাষানটেক, বনানী, উত্তরা এবং বিমানবন্দরে যোগাযোগ সহজ করবে। মেট্রোরেলের পর কালশী ফ্লাইওভার ও ছয় লেনের সড়ক চালু হলে ঢাকার যানজট অনেকটাই কমে যাবে।
ঢাকা উত্তর সিটির উন্নয়নে গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে শেখ হাসিনা বলেন, ২০১১ সালে ঢাকা শহরকে দুই ভাগ করার পর গত ১২ বছরে ৩,৫০০ কোটি টাকার ২৩টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে গত কয়েক বছরে ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি মূল্যের ১৬টি প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় রাজধানীর সৌন্দর্যায়ন, পানি সরবরাহ ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, ফুটপাথ নির্মাণ ও উন্নয়ন, সড়ক, সেতু ও ফ্লাইওভারের পাশাপাশি বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ রাজধানীর যোগাযোগ ও অবকাঠামোর উন্নয়ন করা হয়েছে।
জনসভায় প্রধানমন্ত্রী কালশী বালুর মাঠকে একটি বিনোদন পার্ক হিসেবে গড়ে তোলার ঘোষণা দেন। সেখানে শিশু ও যুবকদের খেলার মাঠ এবং বয়স্ক ব্যক্তিদের চলাচলের জন্য হাঁটার পথ থাকবে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনী (২৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড) প্রায় ১,০১২ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে।
প্রকল্প বিবরণী অনুযায়ী, ফ্লাইওভারটি ইংরেজি ‘ওয়াই’ অক্ষরের মতো। এই প্রকল্পে যাত্রীদের ভ্রমণ সহজ করার লক্ষ্যে আগের চার লেন বিশিষ্ট রাস্তাগুলোকে ছয় লেন করা হয়েছে।
প্রধান চার লেন বিশিষ্ট ফ্লাইওভারটি ইসিবি স্কোয়ার থেকে কালশী ও মিরপুরের ডিওএইচএস হয়ে গেছে। দুই লেনবিশিষ্ট র্যাম্পটি কালশী মোড় থেকে শুরু হয়ে কালশী সড়কে যাবে।
প্রকল্পটির আওতায় একটি পিসি গ্রিডার ব্রিজ, দুইটি ফুল ওভার ব্রিজ, একটি পাবলিক টয়লেট, দুটি পুলিশ বক্স, একটি ৭.৪০ কিলোমিটার আরসিসি ড্রেন, একটি ১৭৫৫ মিটার আরসিসি পাইপ ড্রেন, ৩৩৮৩ মিটার যোগাযোগ তার, পৃথক সাইকেল লেন ও ছয়টি বাস বে নির্মাণ করা হয়েছে।
সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন এলজিআরডি ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম, সেনাপ্রধান জেনারেল এসএম শফিউদ্দিন আহমেদ এবং ঢাকা-১৬ আসনের সংসদ সদস্য মো. ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লা।
মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন এলজিআরডি ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মুহাম্মদ ইব্রাহিম।
২৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মনোয়ারুল ইসলাম সরদার কালশী ফ্লাইওভার ও ছয় লেনের সড়ক সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত প্রেজেন্টেশন দেন। অনুষ্ঠানে কালশী ফ্লাইওভার ও সড়ক প্রকল্পের একটি ভিডিও ডকুমেন্টারিও প্রদর্শিত হয়।
সরকারপ্রধান বলেন, দেশের বড় বড় অবকাঠামো উন্নয়নে এখন পর্যন্ত যা কিছু অর্জন, সবই হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের হাত ধরে।
তিনি বলেন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ ও ঢাকায় ইতোমধ্যে মেট্রোরেল চালু, কম্যুটার রেলওয়ে, ভূগর্ভস্থ টানেল, ঢাকা শহরের চারিদিকে রিং রোড এবং ওয়াটারওয়ে নির্মাণের জন্য কাজ শুরু করা হয়েছে। আমরা গত নভেম্বরে একদিনে ১০০ সেতু উদ্বোধন এবং ডিসেম্বরে একদিনে শত সড়ক/মহাসড়ক উদ্বোধন করা হয়েছে।
এ ছাড়া ঢাকায় হানিফ ফ্লাইওভার, তেজগাঁও-মগবাজার-মালিবাগ ফ্লাইওয়ার, বনানী ফ্লাইওভার, টঙ্গীতে আহসানউল্লাহ মাস্টার ফ্লাইওভার, চট্টগামে আক্তারুজ্জামান চৌধুরী ফ্লাইওভার ও বদ্দারহাট ফ্লাইওভার, ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-ময়মনসিংহ, নবীনগর-ডিইপিজেড-চন্দ্রা, ঢাকা-এলেঙ্গা মহাসড়ক চারলেনে উন্নীত করা, ঢাকা-মাওয়া-জাজিরা এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ সরকার সম্পন্ন করেছে বলেও উল্লেখ প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু টানেল খুব শিগগিরই উদ্বোধন করা হবে। এয়ারপোর্ট থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে এ বছরই যানবাহনের জন্য খুলে দেওয়া হবে। এলেঙ্গা-রংপুর মহাসড়ক, আরিচা মহাসড়ক এবং ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে খুলনা পর্যন্ত এবং চট্টগ্রাম হতে কক্সবাজার পর্যন্ত রেল যোগাযোগ স্থাপনের কাজ চলছে। যমুনা নদীর উপর রেলসেতু নির্মাণ কাজও এগিয়ে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যমুনা নদীর ওপর যখন সেতু করতে যাই। তখন রেল সেতুও সংযুক্ত করতে চাই। বিশ্বব্যাংক বাধা দিয়েছিল। তারা বলেছে, সেটা লাভজনক হবে না। এখন আবার বিশ্বব্যাংকই ফিরে এসেছে, যমুনা নদীতে রেল সেতু করতে। আমি অনুমতি দিয়েছি। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে। দেশটা আমাদের। কোথায় কী হবে, হবে না। কী লাগবে, লাগবে না। এটা আমরাই ভালো বুঝি। এই ধারণাটা আমাদের থাকতে হবে।
উর্দুভাষীদের জন্য উন্নতমানের ফ্ল্যাট নির্মাণের পরিকল্পনাও তাঁর সরকারের রয়েছে বলে অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করে বলেন, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে একটি মানুষও ভূমিহীন ও গৃহহীন থাকবে না।
শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ জনগণের ভোটের অধিকারে বিশ^াস করে। অনেক সংগ্রামের পথ বেয়েই জনগণের ভোটের অধিকার আমরা জনগণের হাতে ফিরিয়ে দিয়েছি। জনগণ আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছে। আমরা ২০০৮ এর নির্বাচনে জয়ী হয়েছি, ২০১৪ এবং ২০১৮ জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে সরকারে এসেছি।
দেশের মানুষ ভোট সম্পর্কে অনেক সচেতন এবং তাদের ভোট চুরি হলে তারা মেনে নেয়না উল্লেখ করে ’৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচন এবং মাত্র দেড় মাসের মাথায় আন্দোলনের মুখে খালেদা জিয়া সরকারের পদত্যাগে বাধ্য হওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেন।
তিনি বলেন, ভোট চোরকে জনগণ কখনো গ্রহণ করেনা। এ প্রসঙ্গে ১ কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটার দিয়ে খালেদা জিয়া সরকারের নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রক্রিয়ারও সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি অনেক কথা বলে। ২০০৮ এর নির্বাচনে তারা মাত্র ২৯ টা আসন পেয়েছিল , আর একটা পেয়েছিল উপ নির্বাচনে। অর্থাৎ ৩০০ সেটির মধ্যে মাত্র ৩০ টা সিট পেয়েছিল। আমরা দেশের উন্নয়নের মাধ্যমে মানুষের আস্থা অর্জন করে তাদের ভোটেই বারবার সরকারে এসেছি।’ এ ব্যাপারে জনগণকে বিভ্রান্ত না হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
তিনি বলেন, সরকার পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনার সঙ্গে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছে এবং বাংলাদেশ আর পেছনে ফিরে তাকাবে না। কারো মুখাপেক্ষী হবেনা। আমরা নিজের খেতে ফসল ফলাবো এবং দেশকে উন্নত করবো। জাতির পিতা বলে গিয়েছিলেন ভিক্ষুক জাতির ইজ্জত থাকেনা। তাই কারো কাছে হাত পেতে চলবোনা। আমরা সম্মানের সংগে বিশ্বে মাথা উঁচু করে চলতে চাই।
তিনি বলেন, নৌকা মার্কা স্বাধীনতা এনেছে, নৌকা মার্কাই যত উন্নয়ন দিয়েছে, সামনেও যত উজান ঠেলে হোক, নৌকা মার্কা এগিয়ে যাবে।
তিনি করোনা পরবর্তী রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বিশ্বমন্দার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে, দেশের প্রতি ইঞ্চি জমি কাজে লাগোনোর মাধ্যমে সার্বিক উৎপাদন বৃদ্ধিতে তাঁর আহ্বান পুণর্ব্যক্ত করেন।