অযত্ন ও অবহেলায় ধ্বংসের মুখে মুক্তিযুদ্ধের শহীদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) কর্মচারী মুহাম্মদ হোসেন বীর প্রতীক ‘স্মৃতি ভবন’। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক প্রফেসর আবু ইউসুফ চবির উপাচার্য থাকাকালীন হাটহাজারীর ধলই ইউনিয়নের সাফিনগর এলাকায় মুহাম্মদ হোসেন বীর প্রতীকের নামে তারই পৈতৃক ভিটায় নির্মাণ করেছিলেন এই ‘স্মৃতি ভবন’।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও বেমালুম ভুলে গেছে এই বীর সেনানীর কথা। তাদের পক্ষ থেকেও নেওয়া হয়নি কার্যকর কোনো পদেক্ষেপ। ফলে তার জন্য নির্মিত স্মৃতি ভবনটি জর্ণাজীর্ণ হয়ে পড়েছে।
একইসঙ্গে হাটহাজারীর বাড়বকুণ্ড সংযোগ সড়কের একটি বাইলেনকে মুহাম্মদ হোসেন বীর প্রতীকের নামে নামকরণ করেন চবির সাবেক উপাচার্য। কিন্তু বর্তমানে সড়কটির নাম ফলক ভেঙে পড়েছে। অথচ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে ক’জন শিক্ষক কর্মকর্তা কর্মচারী মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন মুহাম্মদ হোসেনই এক মাত্র বীর প্রতীক খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযুদ্ধা।
শহীদ মোহাম্মদ হোসেন বীর প্রতীক বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী লাখো শহীদের কাতারে অতি উজ্জ্বল একটি নাম। বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ হোসেনের জন্ম চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার পশ্চিম ধলাই ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রাম সাফিনগরে। বাবা আহমদ মিয়া ও মা আম্বিয়া খাতুন। পাঁচ মেয়ে ও একমাত্র ছেলের মধ্যে সবার বড় মোহাম্মদ হোসেন। বাবা-মা আদর করে তাকে ডাকতো ফরিদ নামে। ইচ্ছা থাকলেও আর্থিক অনটনের কারনে বেশি দূর লেখাপড়া করা সম্ভব হয়নি। তাই হাই স্কুলের পাঠ না চুকিয়েই তাকে জীবিকার সন্ধানে অতি অল্প বয়সেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তরে চেইনম্যানের চাকুরী নিতে হয়।
১৯৭১ সাল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হয়। দেশ মাতৃকার সম্মান রক্ষায় মোহাম্মদ হোসেন মাতৃভূমির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জনের দৃপ্ত শপথ নেন। ২৫ মার্চের পর ট্রেনিং নেয়ার জন্য ভারত চলে যান। সেখানে পশ্চিম বঙ্গের নদীয়া জেলার পলাশীতে নৌ অপারেশনের উপর বিশেষ প্রশিক্ষন শেষ করে চট্টগ্রাম ফিরে আসেন। দেশে ফিরে একই গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ কমান্ডার ফারুক ই আজম বীর প্রতীকের নেতৃত্বে মোহাম্মদ হোসেন মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এছাড়াও অংশ নেন অসংখ্য মিশনে। ১৯৭১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর বন্দরের ১৫ নং জেটির কাছে শত্রুর জাহাজ ধ্বংসের অপারেশনে আত্মাহুতি দেন এই বীর সেনা।
জানা যায়, ১৯৭১ সালের২১ শে সেপ্টেম্বর বন্দরের ১৫ নং জেটির উল্টোদিকে কর্ণফুলী নদীর অপর পাড়ে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডোরা স্থানীয় এক সংগঠকের বাড়িতে আশ্রয় নেন। মূল শেল্টার থেকে প্রাথমিক যে দলটিকে অপারেশনের জন্য নির্বাচিত করা হয়েছিলো সেখানে মোহাম্মদ হোসেনের নাম ছিলো না। এটা জানতে পেরে তিনি ফারুক ই আজম বীর প্রতীকের কাছে অভিযোগের সুরে বলেন, ‘আমি তো যুদ্ধ করতে এসেছি, শেল্টারে অলস সময় কাটাতে নয়।’ তার আগ্রহের কারনে তাকে শেষ পর্যন্ত এই অপারেশনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
রাত আনুমানিক ১১ টা থেকে সাড়ে ১১ টার মধ্যে মোহাম্মদ হোসেন তার কমান্ডার থেকে লিম্প মাইন নিয়ে তা বুকে বেঁধে জয় বাংলা স্লোগান নিয়ে কর্ণফুলী নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এই অপারেশনে পাক হানাদার বাহিনীর দুটি জাহাজ ধ্বংস হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ হোসেন মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য নিজ জীবন উৎসর্গ করেন। তার এই বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতস্বরুপ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। তাছাড়া বাংলাদেশ নৌবাহিনীর গ্যামবোট ‘বি.এন.এস. ফরিদ’ তার ডাকনামেই নামকরন করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মোহাম্মদ হোসেন বীর প্রতীকের ছোট বোনের ছেলে মোহাম্মদ ফয়সাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে অভিযোগ করে বলেন, এলাকার কিছু দুষ্কৃতকারী মোহাম্মদ হোসেন বীর প্রতীকের সম্পত্তি আত্মসাৎ করে নিচ্ছে। সরকারী কোন উদ্যোগ নেই। পাচ্ছে না কোন সরকারী ভাতা। যেটুকু সম্পত্তি আছে তাও দখলে নিচ্ছে অনেকেই। বিচার দিয়েও আমরা বিচার পাচ্ছি না। যে বাড়িটি স্মৃতি হিসেবে আছে সেটিও অবহেলায় অযত্নে পড়ে আছে।