প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে বিশ্বজুড়েই মাস্ক ব্যবহারের প্রচলন অনেক বেড়ে যায়। এশিয়ার দেশ জাপানের নাগরিকরাও এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু এর ব্যাপক বিরূপ প্রভাব পড়েছে জাপানিদের ওপর। দীর্ঘদিন মাস্কে ঢাকা থাকায় মুখের অভিব্যক্তি প্রকাশই যেন ভুলে গেছেন তারা। তাই ‘স্মাইল এডুকেশন’ ক্লাসে ভর্তি হয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন অনেকে। ঘণ্টাপ্রতি ক্লাসের জন্য তাদের গুনতে হচ্ছে ৫৫ দশমিক ৪৩ ডলার।
করোনা মহামারীর পর জাপানের জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশকে দেখলে মনে হতে পারে তারা কেউ হাসতে জানে না। কেউ কেউ হাসার চেষ্টা করলেও যেন তা স্বাভাবিক হচ্ছে না। রীতিমতো গাল টেনে টেনে হাসার চেষ্টা করছেন। এই দৃশ্য রাজধানী টোকিওর একটি স্কুলের, যার নাম ইগাওইকু।
এটিকে বলা হচ্ছে নিখুঁত হাসি শেখার স্কুল! গোমড়ামুখো হয়ে যাওয়া জাপানিদের জন্যই মূলত খোলা হয়েছে এই এক স্কুল। কেউ চাইলে এখানে ভর্তি হয়ে কীভাবে হাসতে হয়, তা জানতে পারবেন।
প্রচলিত কোনও ক্লাস নয়, এখানে চলছে হাসির প্রশিক্ষণ। নোট নিচ্ছেন মনোযোগী শিক্ষার্থীরা। আয়নার সামনে চলছে অনুশীলন। উপরে, নিচে, সামনে, পেছনে টেনে টেনে চলছে মুখমণ্ডলের ব্যায়াম। কিছুক্ষণ পর পর তারা আঙ্গুল দিয়ে তাদের মুখের দুইপাশ প্রসারিত করছেন। মূলত কীভাবে হাসতে হয় তারা সেটাই অনুশীলন করছেন।
টাকার বিনিময়ে কেউ হাসতে শিখবে; এটা আমাদের কাছে অস্বাভাবিক মনে হতে পারে। তবে জাপানে এই হাসি শেখানোর স্কুল বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এর আগে মহামারীর সময় জাপানের সর্বত্র মাস্ক পরার নিয়ম ছিল।
২০ বছরের তরুণী হিমাওয়ারি ইয়োশিদা স্কুলের অন্যান্য কোর্সের মতই হাসি শেখার কোর্সটি নিয়েছেন। জব মার্কেটে ভালো কিছু করে দেখানোর জন্য তার হাসি নিয়ে আরেকটু কাজ করা দরকার বলে মনে করেন ইয়োশিদা।
তিনি বলেন, “আমি কোভিডের সময় আমার মুখের পেশিগুলো খুব একটা ব্যবহার করিনি।”
ইগাওইকু, যার আক্ষরিক অর্থই হাসি শিক্ষা। গত এক বছরে এই স্কুলের চাহিদা অন্তত চারগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। হাসির শিক্ষা নিতে এখানে বিপণন এর সঙ্গে জড়িত মানুষেরা বেশি আসেন। এছাড়াও স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তারাও তাদের এলাকার নাগরিকদের সঙ্গে সৌহার্দ্যময় সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য এই প্রতিষ্ঠানের শরণাপন্ন হন।
মহামারীর আগে থেকেই জ্বরের মৌসুমে বা শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার সময়ে জাপানে মাস্ক পরা অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। মার্চে মাস্ক পরিধানের বিষয়ে সরকার নিয়মকানুন শিথিল করার পরেও অনেকেই প্রতিদিনই মাস্ক পরেন।
মে মাসে জাপানি গণমাধ্যম এনএইচকে একটি জরিপ চালিয়ে জানায়, মাত্র ৮ শতাংশ মানুষ মাস্ক পরা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছেন এবং ৫৫ শতাংশ মানুষ বলেছেন তারা দুই মাস আগে যেমন মাস্ক পরতেন, এখনও তেমনটাই করে চলেছেন।
হাসি শেখার ক্লাসে আসা এক চতুর্থাংশ স্কুলশিক্ষার্থী পাঠদানের সময় মাস্ক পরে থাকেন। তরুণরা মাস্ক পরা জীবনের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন। মাস্ক পরার কারণে অনেক নারী মেকাপ ছাড়াই বের হতে পারছেন আবার ছেলেরা যারা শেভ করেনি, তারাও বিষয়টি লুকাতে পারছেন।
জাপানের সাবেক রেডিও উপস্থাপক কেইকো কাওয়ানো ২০১৭ সালে হাসি প্রশিক্ষণের স্কুলটি তৈরি করেন। পদার্থবিদ্যা ও মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে হাসির গুরুত্ব নিয়ে দীর্ঘদিন লেখাপড়ার পর তিনি তৈরি করেছেন এই লেসন। বর্তমানে ২৩ জন প্রশিক্ষিত শিক্ষক কাজ করছেন তার স্কুলে।
তার সবচেয়ে জনপ্রিয় হাসিটি হলিউড স্টাইল স্মাইলিং টেকনিক। মূলত এই হাসিটি “ক্রিসেন্ট আইজ” এবং “রাউন্ড চিকস” এর সমন্বয়ে গঠিত। সাধারণত শিক্ষার্থীরা তাদের ট্যাবলয়েডে হাসি রেকর্ড করেন এবং এরপর সেটার ওপর তাদের নম্বর দেওয়া হয়।
স্কুলটির প্রশিক্ষক কেইকো কাওয়ানো বলেন, “মুখ, গাল, চোখ-এই হলো প্রকৃত হাসির ক্রম। মহামারীতে বাড়িতে থাকতে থাকতে মুখের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো নড়াচড়া না করাই অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু হাসির মাধ্যমে আরও বেশি মানুষের কাছাকাছি যেতে পারবেন আপনি। জীবন সুন্দর হবে। একটি হাসিমুখ মানে হলো একজন সুখী মানুষের মুখ।”
“জাপান একটি দ্বীপ রাষ্ট্র। ফলে এ দেশের নাগরিকরা সাংস্কৃতিকভাবেই পশ্চিমাদের চেয়ে কম হাসেন,” বিশ্বাস কাওয়ানোর। সূত্র: রয়টার্স, জাপান টুডে