বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ব্যাংকের শাখা ও প্রধান কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পরিচালনা পর্ষদ এই অনিয়মের দায় এড়াতে পারে না। জানা গেছে, ট্রাস্ট ব্যাংকের রাজধানীর দিলকুশা শাখা থেকে ২০১৩ সালে ১২৯ কোটি টাকা ঋণ নেয় ঢালি কনস্ট্রাকশন। ২০১৫ সাল শেষে ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১৫৬ কোটি টাকা। ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে ট্রাস্ট ব্যাংকের ঋণটি অধিগ্রহণ করার জন্য শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকে আবেদন করে ঢালি কনস্ট্রাকশন। ওই বছরের ডিসেম্বর মাসে ট্রাস্ট ব্যাংকে ঢালি কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের ১১৮ কোটি টাকার ঋণ অধিগ্রহণ করে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ধানমন্ডি শাখা। ডিসেম্বর মাসেই শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ঢালি কনস্ট্রাকশন লিমিটেডকে অতিরিক্ত ১৮৮ কোটি টাকা ফান্ডেড এবং ৭০ কোটি টাকার নন-ফান্ডেড ঋণ বিতরণ করে। ২০১৭ সালের আগস্টে আরও ১১৫ কোটি টাকার ঋণ দিয়েছে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক। এর মধ্যে ৮৫ কোটি টাকা ফান্ডেড এবং ৩০ কোটি টাকা নন-ফান্ডেড। কোন কার্যাদেশের বিপরীতে কত টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে সেটাও বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে পারেনি শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক। ঢালি কনস্ট্রাকশনের ঋণ বিতরণে অনিয়ম উঠেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঋণ বিতরণের সময় শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ঢালি কনস্ট্রাকশনের আর্থিক অবস্থা যাচাই-বাছাই করেনি। বিনিয়োগের কার্যাদেশ ও সম্পদের কোনো তথ্য যাচাই করা হয়নি। ঢালি কনস্ট্রাকশনকে ঋণ বিতরণের সময় শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের নির্দেশনা লঙ্ঘন করা হয়েছে। নতুন করে ঋণ বিতরণের সময় নেওয়া হয়নি পযাপ্ত জামানত। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, এই ঋণ আদায় করা অনেক বেশি কঠিন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিভিন্ন কোম্পানির দায় পরিশোধে ব্যর্থতার কারণে ঢালি কনস্ট্রাকশনকে জোর করে ঋণ দিয়েছে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক। ফলে চলতি বছরের এপ্রিল শেষে ঢালি কনস্ট্রাকশনের কাছে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪০৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩৫০ কোটি টাকা ফান্ডেড এবং ৫৮ কোটি নন-ফান্ডেড ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। বারবার তাগাদা দিয়েও টাকা আদায় করতে পারছে না শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক। ঋণের বিপরীতে জামানত হিসেবে ঢালি কনস্ট্রাকশন ৭২১ কাঠা জমি এবং ৩৭ হাজার বর্গফুটের একটি ভবন বন্ধক দিয়েছে। এ বিষয়ে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের একজন উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণমাধ্যমকে বলেছেন, দেশের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ঢালি কনস্ট্রাকশনের অবস্থা ভালো। ২০১৫ সাল থেকে তাদের সঙ্গে আমাদের ব্যবসায়িক সম্পর্ক। তিনি বলেন, মহামারীর কারণে কোম্পানিটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। যদিও আমরা ঋণ আদায়ে আশাবাদী, তবে টাকা ফেরত পেতে আরও সময় লাগবে। শাহজালাল ব্যাংকের মাধ্যমে না করে অন্য ব্যাংকের মাধ্যমে ঢালি কনস্ট্রাকশনের বিল নগদায়ন করার বিষয়ে উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ঢালি কনস্ট্রাকশন নগদ অর্থের প্রয়োজনে এটি করেছে। তাদের ধারণা ছিল আমাদের ব্যাংকে বিল জমা দিলে, ঋণ পরিশোধের জন্য টাকা কেটে নেওয়া হবে। তবে ঋণ বিতরণে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের নীতিমালা লঙ্ঘনের বিষয়ে জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি। ঢালি কনস্ট্রাকশনের চেয়ারম্যান রফিক উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেছেন, আমাদের প্রতিষ্ঠান দেশে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় ভবনসহ বড় বড় সড়ক ও নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। কভিড মহামারির সময় কাজ বন্ধ থাকা এবং নির্মাণ সামগ্রীর অস্বাভাবিক দাম বাড়ার কারণে আমরা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছি। ফলে প্রকল্প ব্যয় বেড়েছে। শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ পরিশোধের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নতুন প্রকল্প হাতে নেওয়া হবে এবং ঋণ পরিশোধ করা হবে। ব্যাংকের সঙ্গে আমাদের ব্যবসায়িক সম্পর্কও অব্যাহত থাকবে। ঢালি কনস্ট্রাকশনের উপদেষ্টা এম এম মিজানুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেছেন, নথিপত্রে কিছু ত্রুটি ছিল; এগুলো দ্রুত সমাধান করা হবে। তিনি বলেন, কোম্পানির যে সম্পদ রয়েছে, তা বিক্রি করে ব্যাংক পাওনা আদায় করতে পারবে। এ ছাড়াও কোম্পানিটি বেশ কয়েকটি নির্মাণ প্রকল্পে যুক্ত রয়েছে। এসব প্রকল্পের কাজ শেষ হলেও ঋণ পরিশোধ করতে পারবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢালি কনস্ট্রাকশনকে ঋণ বিতরণের সময় বিনিয়োগের সমান জামানত প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল পর্ষদ থেকে। কিন্তু শতভাগ জামানত রাখার প্রয়োজনীয়তা থাকা সত্ত্বেও, ১৮৮ কোটি টাকা ফান্ডেড ঋণের বিপরীতে মাত্র ৯০ কোটি টাকার জামানত (জমি ও ভবন) গ্রহণ করা হয়েছিল। কম জামানত নিয়ে বিনিয়োগের বিষয়ে পর্ষদে জানানো হয়নি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্দিষ্ট কার্যাদেশের বিপরীতে বিনিয়োগকৃত অর্থের পরিমাণ এবং সেই কাজের আদেশের ক্ষেত্রে প্রাপ্ত বিলের সংখ্যা সম্পর্কে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন দলকে কোনো তথ্য দিতে পারেনি শাহজালাল ব্যাংক। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৮৮ কোটি টাকার ফান্ডেড এবং ৭০ কোটি টাকার নন-ফান্ডেড ঋণ অনুমোদন এবং ৭২১ কাঠা জমি বন্ধক নেওয়ার আগে একটি আইনি মতামত নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। কিন্তু ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আইনি মতামতকে আমলে নেয়নি ব্যাংকটি। নতুন ঋণের জন্য কোনো জামানত গ্রহণ না করায় ব্যাংকের বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।