পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার বাসিন্দা গিয়াস উদ্দিনকে একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি দেওয়ার কথা বলে সাড়ে চার লাখ টাকা নেন বিপুল চন্দ্র শীল। পরে তিনি গিয়াসের হোয়াটসঅ্যাপে ‘নিয়োগপত্র’ পাঠান। কাজে যোগ দিতে ‘নিয়োগপত্র’ নিয়ে ঢাকায় ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে যান গিয়াস। গিয়ে জানতে পারেন, নিয়োগপত্রটি ভুয়া।
এভাবে কয়েক বছর ধরে নানামুখী প্রতারণার মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে সম্প্রতি বিপুলকে (৩৩) গ্রেপ্তার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। পরে তাঁকে সিআইডি রিমান্ডে নেয়। জিজ্ঞাসাবাদে বিপুল স্বীকার করেন, তিনি একটি প্রতারক চক্রের নেতৃত্বের পর্যায়ে আছেন। গত পাঁচ বছরে তিনি অনেক প্রতারণা করেছেন। এসব তথ্য জানিয়ে সিআইডি সূত্র বলে, বিপুল ইতিমধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
আদালত সূত্র জানায়, জবানবন্দিতে বিপুল বলেছেন, তিনি একটি প্রতারক চক্রের নেতৃত্বের পর্যায়ে আছেন। গত পাঁচ বছরে অনেক প্রতারণা করেছেন তিনি।
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আনিচুর রহমান বলেন, ‘বিপুল একজন মহা প্রতারক। প্রায় সব ধরনের প্রতারণায় তিনি পারদর্শী।’
বিপুলের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগে ৫ জুন রাজধানীর মতিঝিল থানায় একটি মামলা হয়। মামলার বাদী প্রতারণার ভুক্তভোগী দাবিদার গিয়াস।
মামলার এজাহারে গিয়াস অভিযোগ করেন, এক প্রতিবেশীর মাধ্যমে বিপুলের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। তাঁর সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন বিপুল। তিনি তাঁকে (গিয়াস) একটি সরকারি ব্যাংকে ‘বিজনেস অফিসার’ পদে চাকরির প্রস্তাব দেন। এ জন্য গিয়াসের কাছে সাড়ে চার লাখ টাকা চান বিপুল। টাকা দিলে তিন মাসের মধ্যে চাকরি হবে বলে আশ্বাস দেন। এই কথায় বিশ্বাস করে গত বছরের ১ জুন বিপুলকে প্রথমে এক লাখ টাকা দেন গিয়াস। তাঁর মেইলে চাকরির পরীক্ষার প্রবেশপত্র পাঠানো হয়। পরে বিপুল ফোন করে গিয়াসকে বলেন, তাঁর পরীক্ষা দেওয়ার দরকার হবে না। গিয়াসের হয়ে ব্যাংকের এক কর্মকর্তা পরীক্ষা দিয়ে দেবেন। কয়েক দিন পর গিয়াসের মুঠোফোনে খুদেবার্তা আসে যে তিনি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। তাঁকে বাকি টাকা দিয়ে নিয়োগপত্র সংগ্রহ করতে বলেন বিপুল। বাকি সাড়ে তিন লাখ টাকা দেওয়ার পর গিয়াসের হোয়াটসঅ্যাপে বিপুল একটি নিয়োগপত্র পাঠান। এই নিয়োগপত্র নিয়ে চাকরিতে যোগদান করতে গিয়েই গিয়াস জানতে পারেন, তিনি প্রতারিত হয়েছেন। বিপুলকে ফোন করে টাকা ফেরত চাইলে তিনি হত্যার হুমকি দেন বলে মামলায় অভিযোগ করেন গিয়াস।
মামলার পরই রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে বিপুলকে সিআইডি গ্রেপ্তার করে। সিআইডি সূত্রের ভাষ্য, গ্রেপ্তারের পর বিপুল ও তাঁর চক্রের প্রতারণার নানা তথ্য জানা যায়। তাঁর বাড়ি বরগুনা জেলার বেতাগী এলাকায়। তিনি স্বল্পশিক্ষিত হলেও প্রতারণায় সুদক্ষ। গ্রেপ্তারের পর আদালতের মাধ্যমে বিপুলকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে তিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
আদালত সূত্র জানায়, জবানবন্দিতে বিপুল বলেছেন, তিনি জুড়ী ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস নামের একটি কোম্পানিতে চাকরি করতেন। সেখানে নিজাম উদ্দিন ওরফে সোহাগ নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেওয়ার জন্য বিপুলকে লোকজন জোগাড় করতে বলেন নিজাম। প্রতারণার অংশ হিসেবে গিয়াসের কাছ থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা নেওয়া হয়। আরও অনেক প্রতারণার মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার কথাও জবানবন্দিতে স্বীকার করেছেন বিপুল।
সিআইডি সূত্র জানায়, বিপুল ও নিজাম ২০১৮ সালে প্রতারণার চক্রটি গড়ে তোলেন। বিপুল বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে চাকরিপ্রার্থী সংগ্রহ করতেন। তাঁদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করতেন। আর কাগজপত্র জাল-জালিয়াতির কাজটি করতেন নিজাম। প্রতারণার মাধ্যমে পাওয়া টাকার বেশির ভাগ নিতেন নিজাম। তিনি নিজেকে কখনো ব্যাংকের বড় কর্মকর্তার পরিচয় দিতেন। তাঁর আত্মীয়-স্বজন সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে চাকরি করেন বলে তিনি দাবি করতেন।
চক্রটি মূলত পাবনার বিভিন্ন এলাকায় লোকজনের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিল বলে সিআইডি জানায়। সিআইডি সূত্রের ভাষ্য, তারা প্রাথমিকভাবে পাঁচজন ভুক্তভোগীর তথ্য পেয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানতে পেরেছে, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেওয়ার কথা বলে টাকা নিয়ে ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়ে আসছিলেন চক্রের সদস্যরা। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অফিস সহকারী পদে চাকরি চাকরি দেওয়ার কথা বলে ঈশ্বরদীর বাসিন্দা আবদুর রহমানের কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা নিয়েছেন বিপুল। আবার ঈশ্বরদীর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সামনের সরকারি খাসজমির বরাদ্দ পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে স্থানীয় বাসিন্দা গোলাম নবীর কাছ থেকে ৮ লাখ ১৫ হাজার টাকা নিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি বিপুল ও তাঁর সহযোগীরা বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা সনদ, চিকিৎসা সনদ, এমনকি পুলিশি সনদও জাল করে তা বিক্রি করতেন।
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আনিচুর রহমান বলেন, বিপুলের চক্রের অন্য সদস্যদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।