হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের আংশিক উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশকে একটি এভিয়েশন হাব হিসেবে গড়ে তুলতে ‘স্বপ্নের সাথে বাস্তবতার সংযোগ’ স্লোগানে শনিবার (৭ অক্টোবর) এটি উদ্বোধন করা হবে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সফল করতে এরই মধ্যে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে শাহজালাল বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এবং বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)।
শুক্রবার (৬ অক্টোবর) সরেজমিনে দেখা যায়, তৃতীয় টার্মিনালের দক্ষিণ পাশে ভিআইপি অংশে দুটি বোর্ডিং ব্রিজ স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে। এর মধ্যে এক বোর্ডিং ব্রিজের সামনে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি উড়োজাহাজ রাখা হয়েছে। বোর্ডিং ব্রিজ দিয়ে বিমানের ভেতরে আসা-যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া তিন তলাবিশিষ্ট তৃতীয় টার্মিনালে ওঠা- নামার ব্যবস্থা, ভেতর-বাইরে সব জায়গায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং সাজানো হয়েছে।
আগামীকাল শনিবার তৃতীয় টার্মিনালের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান নিয়ে শুক্রবার গণমাধ্যমে কথা বলেন বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমরা বলতে পারি তৃতীয় টার্মিনালটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাংলাদেশকে একটি এভিয়েশন হাব হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রথম মাইলফলক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন স্থাপনা থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটের ট্রায়াল সাক্ষী করে নতুন দৃশ্যমান টার্মিনালের আংশিক উদ্বোধন করবেন।’
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘নতুন টার্মিনালের ৯০ শতাংশ কাজ সফট লঞ্চিংয়ের জন্য সম্পন্ন হয়েছে। শনিবার থেকে এয়ারলাইন্সগুলো টার্মিনালের নতুন পার্কিং বে ব্যবহার করতে পারবে। তবে সিস্টেম ইন্টিগ্রেশন এবং ক্রমাঙ্কন সম্পন্ন হওয়ার পর তৃতীয় টার্মিনাল আগামী বছরের শেষে যাত্রীদের ব্যবহারের জন্য পুরোপুরি চালু হবে।’
নতুন টার্মিনালটি বিশ্বমানের সুযোগ-সুবিধা এবং যাত্রী পরিষেবা দিয়ে দেশের চিত্র পাল্টে দেবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক আলোসহ থার্ড টার্মিনালের ফ্লোর এবং সিলিংয়ে নজরকাড়া প্যাটার্নের বৈশিষ্ট্যগুলো খুবই পরিশীলিত। যাত্রীরা নতুন টার্মিনালের বিশ্বমানের সুবিধার প্রশংসা করবে, যা আমরা এখানে আগে কখনো পাইনি।’
২০১৭ সালে শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। তবে নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২১ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাপানি সহযোগিতা সংস্থা জাইকা ঋণ হিসেবে দিচ্ছে ১৬ হাজার ১৪১ কোটি টাকা। বাকি টাকা দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। নির্মাণকাজ করছে জাপানের মিতসুবিশি ও ফুজিতা এবং দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাং।
বেবিচক সূত্র জানান, এখন শাহজালাল বিমানবন্দরের টার্মিনাল-১ ও টার্মিনাল-২ এর অ্যাপ্রোনে ২৯টি বিমান রাখা যায়। ৫ লাখ ৪২ হাজার বর্গমিটার আয়তনের তৃতীয় টার্মিনাল চালু হলে অ্যাপ্রোনে আরও ৮ থেকে ১০টি উড়োজাহাজ রাখা যাবে। ফলে একসঙ্গে ৩৭টি উড়োজাহাজ পার্ক করে রাখা যাবে। নতুন টার্মিনালে ২৬টি বোর্ডিং ব্রিজের ব্যবস্থা থাকবে। এর মধ্যে আগামী অক্টোবরে ১২টি বোর্ডিং ব্রিজ চালু হবে। বহির্গমনের জন্য মোট চেক-ইন কাউন্টার থাকবে ১১৫টি। যার মধ্যে ১৫টি সেলফ সার্ভিস চেক-ইন কাউন্টার।
এ ছাড়া ১০টি স্বয়ংক্রিয় পাসপোর্ট নিয়ন্ত্রণ কাউন্টারসহ বহির্গমন ইমিগ্রেশন কাউন্টার থাকবে ৬৬টি। আগমনীর ক্ষেত্রে পাঁচটি স্বয়ংক্রিয় চেক-ইন কাউন্টারসহ মোট ৫৯টি কাউন্টার থাকবে। তৃতীয় টার্মিনালে আগমনী যাত্রীদের জন্য ১৬টি লাগেজ বেল্ট থাকবে। অতিরিক্ত ওজনের ব্যাগেজের জন্য থাকবে চারটি আলাদা বেল্ট।
বেবিচক জানায়, থার্ড টার্মিনালের নিচতলায় থাকবে ব্যাগেজ হ্যান্ডলিং সিস্টেম। দ্বিতীয় তলায় থাকবে বহির্গমন লাউঞ্জ, ক্যানটিন ও বোর্ডিং ব্রিজ। থাকবে সুপরিসর ডিউটিফ্রি শপ এবং বহির্গমন লাউঞ্জ। ২ লাখ ৩০ হাজার বর্গমিটার আয়োতনের তৃতীয় টার্মিনাল ভবনে বছরে যাত্রী ধারণ ক্ষমতা প্রায় এক কোটি ২০ লাখ।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল ভবন নান্দনিক নকশায় সাজানো হয়েছে। এর মধ্যে মূল টার্মিনাল ভবনের অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা সবচেয়ে আকর্ষণীয়। এখন সেখানে বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি স্থাপনের কাজ চলছে। এক হাজার ৪৪টি গাড়ি ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন বহুতল কার পার্কিং তৈরির কাজ চলছে। বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের জন্য কাস্টমের একটি হল ও ছয়টি চ্যানেল তৈরির কাজ চলছে। এর মধ্যে তৃতীয় টার্মিনালের দক্ষিণ প্রান্তে ৩ হাজার ৬৫০ বর্গমিটার জায়গাজুড়ে ভিভিআইপি ও ভিআইপি যাত্রীদের জন্য আলাদা বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে। এ ছাড়া গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য তৃতীয় টার্মিনালের সঙ্গে বহুতল কার পার্কিং ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। এখানে এক হাজার ৩৫০টি গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা থাকবে।
শাহজালাল বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, এখন শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রথম ও দ্বিতীয় টার্মিনালে দিনে ৩০টির বেশি উড়োজাহাজ সংস্থার ১২০-১৩০টি প্লেন উড্ডয়ন ও অবতরণ করে। প্রতিদিন এসব উড়োজাহাজের প্রায় ২০ হাজার যাত্রী বিমানবন্দরের দুটি টার্মিনাল ব্যবহার করেন। এ হিসাবে বছরে প্রায় ৮০ লাখ যাত্রীর সেবা দেওয়ার সুযোগ আছে। তৃতীয় টার্মিনাল চালু হলে আরও এক কোটি ২০ লাখ যাত্রীকে সেবা দেওয়া সম্ভব হবে।
তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প সূত্র জানায়, নতুন টার্মিনাল ভবনের বহির্গমন পথে ১০টি স্বয়ংক্রিয় পাসপোর্ট কন্ট্রোল বা ই-গেইট থাকবে। যেখানে যাত্রীরা নিজেরাই ইমিগ্রেশন করাতে পারবেন। তাদের আর ইমিগ্রেশন পুলিশের মুখোমুখি হতে হবে না। তবে নিজেরা করতে না চাইলে তাকে সহযোগিতা করতে ৫৬টি বহির্গমন ইমিগ্রেশন কাউন্টারও প্রস্তুত থাকবে। সেখানে ইমিগ্রেশন করবে ইমিগ্রেশন পুলিশ। এ ছাড়া যেসব যাত্রী অন্যান্য দেশ থেকে বাংলাদেশে ঢুকবেন তাদের জন্য ৫টি ই-গেট থাকবে। পাশাপাশি থাকবে ৫৪টি অ্যারাইভাল ইমিগ্রেশন কাউন্টার।