ফেসবুক আইডি হ্যাক হয়েছে, এমনটা জানিয়ে সাতক্ষীরা সদর থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন এক তরুণী (২১)। ওই দিন রাতেই আত্মহত্যা করেন তিনি। এই আত্মহত্যায় প্ররোচনা দিয়েছেন, এমন অভিযোগ এনে তরুণীর এক বান্ধবীসহ তিন-চারজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন তাঁর বাবা। এই ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ভার্চ্যুয়াল প্রেমের এক জটিল গল্পের সন্ধান পেয়েছে। যেখানে গল্পের শুরুটা করেছিলেন আত্মহত্যা করা তরুণী নিজেই। আর শেষটা হয়েছে তাঁর আত্মহননের মধ্য দিয়ে।
সিআইডি বলছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া এক বান্ধবীর ছবি দিয়ে ওই তরুণী অন্য নামে ফেসবুকে একটি আইডি খুলেছিলেন। সেই আইডি থেকেই সৌরভ দাস গুপ্ত (২১) নামে এক তরুণের সঙ্গে তাঁর ভার্চ্যুয়াল প্রেমের সম্পর্ক হয়। সৌরভ ওই তরুণীকে বা তরুণী সৌরভকে কখনো সরাসরি দেখেননি। ভিডিও কলেও কথা হয়নি। তরুণীটি সৌরভকে যেসব ছবি পাঠিয়েছিলেন, তার কোনোটাই তাঁর নিজের ছিল না। বান্ধবীর ছবি নিজের বলে পাঠিয়েছিলেন। সম্পর্কের একপর্যায়ে প্রতারিত হওয়ার বিষয়টি টের পান সৌরভ। তারপর ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে খোঁজখবর নিয়ে তিনি সন্ধান পান ছবির আসল তরুণীর এবং ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁদের মেসেঞ্জারের অন্তরঙ্গ কথোপকথন ছড়িয়ে দেন ছবির তরুণীর পরিচিত ব্যক্তিদের মধ্যে।
সৌরভ দাস গুপ্ত রাঙামাটি সরকারি কলেজের গণিত প্রথম বর্ষের ছাত্র। ফেসবুক থেকে প্রাপ্ত তথ্য এবং ইন্টারনেটের আইপি লগ [কোন ব্যক্তি কোন সময় ইন্টারনেট-সেবা নিচ্ছেন, তা ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোয় (আইএসপি) রেকর্ডভুক্ত করে রাখার উপায় হলো ‘আইপি লগ’] বিশ্লেষণ করে গত ৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের হালিশহর থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। গতকাল বৃহস্পতিবার সাতক্ষীরার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. রেজওয়ানুজ্জামানের কাছে তিনি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। সেখানে পুরো ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরেন ওই তরুণ।
ঘটনার ভুক্তভোগী তরুণীটি আত্মহত্যা করায় বর্ণনাটি একপক্ষীয়। তবে সিআইডির তদন্তকারী কর্মকর্তারা বলেছেন, ঘটনা সম্পর্কে সৌরভের বর্ণনার সঙ্গে তাঁরা পারিপার্শ্বিক তথ্য-প্রমাণের মিল পেয়েছেন।
সৌরভ দাস গুপ্তের ভাষ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ফেসবুকে সাতক্ষীরার ওই তরুণীর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়। তরুণীটি তাঁকে একটি কবিতা লিখে দিতে বলেন। সেই কবিতা পেয়ে তরুণী তাঁর প্রতি দুর্বলতা দেখান। তাঁকে প্রেম নিবেদন করেন। ২০১৯ সালের ১৬ নভেম্বর সৌরভও তাতে সাড়া দেন। নিয়মিত মেসেঞ্জার ও ফোনে কথা হয় তাঁদের। কিন্তু কখনো ভিডিও কলে কথা হয়নি। সরাসরিও দেখা হয়নি। তরুণী তাঁকে ছবি পাঠাতেন। তাঁদের মধ্যে ভুল–বোঝাবুঝি হতো। আবার ঠিক হয়ে যেত।
সৌরভ বলেন, একপর্যায়ে তিনি সন্দেহের ভিত্তিতে ওই তরুণীকে কিছু প্রশ্ন করেন। সদুত্তর না পাওয়ায় পর তাঁদের মধ্যে ভুল–বোঝাবুঝি বাড়তে থাকে। তখন তিনি তরুণীর ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে খোঁজখবর নিতে শুরু করেন। তাঁকে মেয়েটির পাঠানো তিনটি ছবি ওই আইডিতে আপলোড করেন। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছবির মেয়েটি অর্থাৎ ওই তরুণীর বান্ধবী এসে জানান ছবিগুলো তাঁর। তিনি সৌরভের সঙ্গে কখনো ফেসবুকে কথাবার্তা বলেননি। মেয়েটি ছবিগুলো ডিলিট করে দিতে বলেন। সৌরভ নিশ্চিত হন, এত দিন নিজের বলে তাঁকে যে ছবিগুলো পাঠিয়েছেন ওই তরুণী, তার সবই ছিল তরুণীর বান্ধবীর।
সৌরভ বলেন, এরপর তিনি ওই তরুণীর আসল ছবি সংগ্রহ করে পুরো বিষয়টি লিখে তরুণীর আইডিতে পোস্ট দেন। তরুণীর ১৯ জন পরিচিত ও স্বজনের কাছে বিভিন্ন স্ক্রিনশট পাঠান। এরপর তরুণীটির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া সেই বান্ধবী আরও কয়েকজন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে মেয়েটির বাড়িতে গিয়ে তাঁকে শাসিয়ে আসেন। সেই শাসানোর একটি ভিডিও তাঁরা সৌরভকেও পাঠান। সৌরভের দাবি, এই ঘটনার পর ওই তরুণী যে আত্মহত্যা করেছেন, তা তিনি জানতেন না। কারণ, পরবর্তী সময়ে তরুণীটির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া বান্ধবী ফেসবুকে তাঁকে ব্লক করে দেন।
এ ঘটনায় সাতক্ষীরা থানায় করা মামলায় ওই তরুণীর বাবা বলেছেন, গত বছরের ৬ নভেম্বর এক আত্মীয় তাঁদের ফোন করে জানান, তাঁর মেয়ের ফেসবুক আইডি হ্যাক হয়েছে। সেখান থেকে তাঁর মেয়ের ছবিসহ অশ্লীল কথাবার্তা লিখে পোস্ট করেছে। এ ঘটনায় তাঁরা ৮ নভেম্বর থানায় জিডি করেন।
ওই দিনই বিকেল পাঁচটার দিকে তাঁর মেয়ের এক বান্ধবীসহ (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া) চারজন তাঁদের বাসায় আসেন। তাঁর মেয়েকে ‘মানহানিকর বিভিন্ন কথাবার্তা’ বলেন এবং ‘চরিত্র নিয়ে বিভিন্ন কথা শোনান ও হুমকি দেন।’ সেদিন খাওয়াদাওয়া শেষে রাত সাড়ে ১১টায় তাঁর মেয়ে ঘুমানোর জন্য নিজের ঘরে যান। পরদিন সকাল ছয়টায় তাঁর স্ত্রী মেয়েকে ডাকাডাকি করেন। কোনো সাড়া না পেয়ে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে তাঁরা দেখেন নিজের ব্যবহৃত ওড়না দিয়ে গলায় ফাঁস লাগিয়ে ঘরের সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলে আত্মহত্যা করেছেন মেয়েটি।
সিআইডির অতিরিক্ত উপপুলিশ সুপার মাহমুদুল ইসলাম তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, পত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবর থেকে তাঁরা এই আত্মহত্যার ঘটনা জানতে পারেন। এরপর ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন তাঁরা। কারণ, সৌরভ দাস গুপ্ত তাঁর নিজের মুঠোফোন থেকে কখনোই ওই তরুণীর হ্যাক করা ফেসবুক আইডি ব্যবহার করেননি। পরবর্তীকালে আইপি লগ বিশ্লেষণ করে সৌরভের এক বন্ধুকে আটক করেন তাঁরা। তাঁর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সৌরভকে শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করা হয়।
সূত্র : প্রথম আলো