বছর বছর কয়েক শ কোটি টাকার লোকসানে নিমজ্জিত থাকা ২৫টি পাটকল বন্ধ করার পর এখনো চালু করতে পারেনি সরকার। বেসরকারি উদ্যোক্তাদের ইজারা দিয়ে বন্ধ পাটকল চালু করার পরিকল্পনা থাকলেও তা হয়নি। এরই মধ্যে আট মাস পেরিয়েছে। পাটকল বন্ধের কারণে ৫০ হাজারের বেশি শ্রমিক বেকার হলেও কর্মকর্তারা বহাল তবিয়তেই আছেন। পাটকলের চাকা না ঘুরলেও প্রায় বসেই বসেই বেতন নিচ্ছেন বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) প্রায় তিন হাজার কর্মকর্তা–কর্মচারী।
পাটকল বন্ধের আট মাস পার হওয়ার পরও সব শ্রমিকের পাওনা শোধ করতে পারেনি বিজেএমসি। আবার ইজারা দিয়ে কবে নাগাদ পুনরায় পাটকল চালানো যাবে, তা সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না সংস্থাটির কর্মকর্তারা। যে প্রক্রিয়ায় পাটকল ইজারা দেওয়ার চিন্তাভাবনা চলছে, সেটি সফল হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন বেসরকারি খাতের অনেক উদ্যোক্তা। তাঁরা বলছেন, মধ্যমেয়াদি ইজারা দিলে ব্যাংক অর্থায়ন করবে না। নিজের গাঁটের ৪০০-৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে তা তুলে আনাও কঠিন। এ ছাড়া সরকারের হুটহাট নীতি পরিবর্তনের ঝুঁকি তো আছেই।
সরকারি পাটকল বন্ধ হলেও বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের হাত ধরে করোনাকালেও পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি বাড়ছে। চলতি বছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই–ফেব্রুয়ারি) পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি বেড়েছে ২৩ শতাংশ, যেখানে তৈরি পোশাক, চামড়া, চামড়াজাত পণ্যসহ অন্য অনেক খাতের রপ্তানি কমে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে আজ ৬ মার্চ জাতীয় পাট দিবস পালিত হচ্ছে। শুরুর দিকে দিবসটি নিয়ে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা থাকলেও চলতি বছর করোনার কারণে চুপচাপ বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়।
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে দায়িত্ব নেওয়ার আগে নির্বাচনী ইশতেহারে পাটশিল্পকে লাভজনক ও বেসরকারীকরণ বন্ধ করার কথা বলেছিল। সরকার গঠনের পর তারা বন্ধ দুই পাটকল চালু করে। বেসরকারীকরণ করা তিন পাটকল ফিরিয়ে এনে আবার চালু করে। এ জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দও দেওয়া হয়। তবে লাভের লাভ কিছু হয়নি। ২০১০-১১ অর্থবছরেই ১৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা মুনাফার পর থেকে ধারাবাহিকভাবে লোকসান হচ্ছে। গত ১১ বছরেই ৪ হাজার ৮৫৯ কোটি টাকা লোকসান গুনেছে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল। তার মধ্যে সর্বশেষ পাঁচ বছরে লোকসানের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৯৮১ কোটি টাকা।
লোকসানের বোঝা বইতে না পেরে ২৫ পাটকলের ২৪ হাজার ৮৮৬ জন স্থায়ী শ্রমিককে স্বেচ্ছা–অবসরে (গোল্ডেন হ্যান্ডশেক) পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করে ১ জুলাই পাটকল বন্ধ করে দেয় সরকার। তখন পাটকলগুলোতে বদলি শ্রমিক ছিলেন ২৩ হাজার ৮৪২ জন। দৈনিকভিত্তিক শ্রমিকের সংখ্যাও কম ছিল না, ৮ হাজার ৪৬৩ জন। প্রসঙ্গত, বিজেএমসির আওতায় গত জুন পর্যন্ত ২৬টি পাটকলের মধ্যে চালু ছিল ২৫টি। এর মধ্যে ২২টি পাটকল ও ৩টি নন–জুট কারখানা।
বিজেএমসির চেয়ারম্যান মো. আবদুর রউফ গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, চলতি মাসের শেষ দিকে পাটকল ইজারা দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হতে পারে। যেসব প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নেবে, তাদের মধ্য থেকে যোগ্যদের নিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা করা হবে। তারপর তাদের কাছ থেকে প্রস্তাব চাওয়া হবে। প্রথম ধাপে যতগুলো সম্ভব হবে, ততগুলো মিল ইজারা দেওয়া হবে।
শুরুতে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে (পিপিপি) বন্ধ পাটকল চালুর পরিকল্পনা করেছিল বিজেএমসি। তখন বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীকে পাটকল পরিদর্শনের সুযোগও করে দেয় করপোরেশন। তাঁরা পিপিপিতে পাটকল চালাতে রাজি নন। ব্যবসায়ীরা চান দীর্ঘমেয়াদি ইজারা। শেষ পর্যন্ত মধ্যমেয়াদি ইজারা দেওয়ার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
পাটকল বন্ধ করতে স্থায়ী শ্রমিকদের চাকরি গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে অবসায়নের সিদ্ধান্ত হয়। তাতে একেকজন স্থায়ী শ্রমিক ১৪ লাখ থেকে ৫৪ লাখ টাকা পাবেন। শ্রমিকদের পাওনার ৫০ শতাংশ অর্থ নগদে ও বাকিটা তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র আকারে সেপ্টেম্বরের মধ্যে পরিশোধ করা হবে। এ ছাড়া ২০১৩ সাল থেকে অবসরে যাওয়া ৮ হাজার ৯৫৬ শ্রমিকের পাশাপাশি বদলি শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করা হবে। সে জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ চায় পাট মন্ত্রণালয়।
বিজেএমসির তথ্যানুযায়ী, দৈনিক ভিত্তিতে পরিচালিত সিরাজগঞ্জের জাতীয়, খুলনার খালিশপুর ও দৌলতপুর এবং চট্টগ্রামের কেএফডি—এই চারটি পাটকলের শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি গত আগস্টে পরিশোধ করা হয়। বাকি ২১ পাটকল শ্রমিকদের তাঁদের পাওনার অর্ধেক নগদে পরিশোধের জন্য অর্থ বিভাগ ১ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৫৯৯ কোটি টাকা শ্রমিকদের ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়েছে। পাওনার ৫০ শতাংশ সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে পরিশোধের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। তবে ৩ হাজার ৯৫ জন স্থায়ী শ্রমিক এখনো কোনো পাওনা বুঝে পাননি। বদলি শ্রমিকের পাওনা বাবদ ৩০৫ কোটি টাকা অর্থ বিভাগ এখনো ছাড়ই করেনি।
এদিকে পাটকল বন্ধ হওয়ার কারণে শ্রমিকেরা বেকার হলেও বিজেএমসির কর্মকর্তারা আগের মতোই আছেন। বর্তমান রাজধানীর দিলকুশার প্রধান কার্যালয় ও পাটকলগুলোতে ১ হাজার ৩৩ জন কর্মকর্তা রয়েছেন। কর্মচারীর সংখ্যা ১ হাজার ৭৫২ জন। পাটকলগুলো উৎপাদনে না থাকায় অধিকাংশ কর্মকর্তারই হাতে বর্তমানে কোনো কাজ নেই। কিন্তু মাস শেষে বেতন ঠিকই পাচ্ছেন তাঁরা।
অবশ্য বিজেএমসির চেয়ারম্যান দাবি করলেন, শ্রমিকের পাওনা পরিশোধ করাটা বিরাট কর্মযজ্ঞ। সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর হাতেই কাজ আছে। তবে পাটকলের উৎপাদন বন্ধ থাকায় আগের মতো পূর্ণোদ্যমে কাজ করতে হচ্ছে না। সব শ্রমিকের টাকা দেওয়া হলে কাজ কমে আসবে।
সামগ্রিক বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, পাটকল বন্ধ ও পুনরায় চালু করার বিষয়ে শুরু থেকেই সরকার দ্বিধান্বিতভাবে কাজ করছে। ফলে শ্রমিক ছাঁটাই করা হলেও বিজেএমসির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রয়ে গেছেন। এতে করে সরকারের আর্থিক দায় বাড়ছে। আসলে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করা প্রয়োজন।