আরএম সেলিম শাহী, জেলা প্রতিনিধি শেরপুরঃ শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার সীমান্তবর্তী বালিজুরি খ্রিস্টান পাড়া গ্রামের খ্রিস্টান গারো আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোকেরা নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। এ গ্রামে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের অর্ধ শতাধিক পরিবারের বসবাস। গারো পাহাড়ের পাদদেশে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্ত ঘেঁষে অবস্থিত উপজেলার রানিশিমুল ইউনিয়নের বালিজুরি খ্রিস্টানপাড়া গ্রামের ওই অর্ধ শতাধিক পরিবারের ছোট বড়ো নারী-পুরুষ আবাল বৃদ্ধ বনিতাসহ চার শতাধিক লোকের বসবাস। অভাব অনটন দুঃখ আর দুর্দই যেন এ গ্রামবাসীদের নিত্য সঙ্গী। এরা পায় না তুলনামুলকভাবে সরকারি কোন সাহায্য সহযোগিতা। এসব পরিবারের সদস্যদের নেই কোন জমিজমা। বন বিভাগের জমির উপর ঘরবাড়ি নির্মাণ করে বসবাস করে আসছেন এ সম্প্রদায়ের লোকেরা।
ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্ত ঘেঁষে অবস্থিত শ্রীবরদী উপজেলার রানিশিমুল ইউনিয়নের বালিজুরি খ্রিস্টান পাড়া গ্রামটি পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত। উত্তরে উচু পাহাড়,পশ্চিমে উচু পাহাড়, পূর্ব দিকে উঁচু পাহাড়। দক্ষিনে সমতল ভূমি। এ গ্রামে প্রবেশ করলে যে কারো কাছেই মনে হবে এ গ্রামটি যেন ছিট মহল। শ্রীবরদী উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দুরে এ গ্রামটি আবস্হিত। গ্রামের মানুষ প্রায় সবাই দিনমজুর। শিক্ষা ধিক্ষা নেই বললেই চলে। ক্ষেতে খামারে কৃষির উপর শ্রম বিক্রি করে পরিবারের সদস্যদের জীবন জীবিকা নির্বাহ করেন তারা। হাতে কোন কাজ না থাকলে তখন পাহাড় থেকে জ্বালানি সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করে চলে তাদের জীবন জীবিকা।কিন্তু এখন পাহাড়েও নেই জ্বালানি। একদিন কাজে না গেলে সেদিন তাদের দিনকাটে অনাহারে অর্ধাহারে। পাহাড়ি আলু ও লতা পাতা খেয়ে দিনাতিপাত করতে হয় তাদের। এছাড়াও গত দুই যুগ ধরে এ গ্রামে শুরু হয়েছে বন্যহাতির তান্ডব। উপর্যুপরি বন্যহাতির তান্ডবে বিপর্যস্ত হয়ে পরেছে গ্রামবাসীরা। তাড়া গত দুই যুগ ধরে দারিদ্রতা ও বন্যহাতির সাথে লড়াই করে টিকে আছে কোন রকমে। এদের পেটে নেই ভাত ও পরনে নেই কাপড়। অতি কষ্টে মানবেতর জীবন যাপন করে আসছেন তারা। ৫/১০ পরিবার ছাড়া প্রতিটি পরিবারের অবস্তাই করুন।
সরেজমিনে অনুসন্ধানে গিয়ে গ্রামবাসীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে তাদের এসব দুঃখ আর দুর্দশার কথা। এ গ্রামের মানুষের দুর্ভোগের যেন শেষ নেই। দীর্ঘদিন ধরে হাতি আতংকে রাত কাটে তাদের। দারিদ্রতা ও বন্যহাতির সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে টিকে আছেন তাঁরা। এছাড়া বনের জমিতে বসবাস করায় উচ্ছেদ আতংকে ভুগছেন গ্রামবাসীরা। বন কর্মচারিরা প্রতিনিয়ত ভয়ভীতি প্রদর্শন করে আসছেন গ্রামবাসীদের। তাদের রোপিত গাছ ও ফলমূল ব্যাবহার করতে পারছেন না এগ্রামে রয়েছে বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট। রাস্তা ঘাটের বেহাল দশা। প্রতিটি বাড়িতে এখনও বিদুৎ পৌছেনি। বালিজুরি ফরেষ্ট রেঞ্জ অফিস থেকে এ গ্রামে প্রবেশের একমাত্র রাস্তাটি সংস্কার সম্প্রসারন ও পাকা করনের অভাবে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পরেছে। শুস্কমৌসুমে যেমন তেমন বর্ষা মৌসুমে এ গ্রামে প্রবেশ করা কষ্টসাধ্য হয়ে পরে।এ গ্রামের বিহার জাম্বিল বলেন নির্বাচনের সময়ে জনপ্রতিনিধিরা রাস্তা নির্মানের আশ্বাস দিয়ে আমাদের কাছে ভোট নেয়। কিন্তু পরে কেউ আর আমাদের খুজ খবর নেন না। তিনি বলেন রাস্তাটি পাকাকরণের অভাবে জরুরি ভিত্তিতে কোন রোগী হাসপাতালে নেওয়া সম্ভব হয় না। এ গ্রামে চলে না কোন যানবাহন। প্রায় দু কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিয়ে বালিজুরি বাজারে এসে অটোযোগে যাতায়াত করতে হয় ভাইয়া ডাঙ্গা ও শ্রীবরদী উপজেলা সদরে। ওই গ্রামের আদিবাসী নারি শৈল ম্রং জানান, তার ২ছেলে ৩মেয়েসহ ৭ সদস্যের পরিবার ছিল তার। গত চার বছর পূর্বে বন্যহাতির পায়ে পিস্ট হয়ে তার স্বামী বিরুন ম্রং এর মৃত্যু হয়। অভাব অনটন ও আর্থিক সংকটের কারনে তার ছেলে মেয়েদের পড়ালেখাও করাতে পারছেন না তিনি। অনাহারে অর্ধাহারে মানবেতর জীবনযাপন করছে হচ্ছে তাদের। বিমলা রেমা (৫৫) জানান, তার স্বামী ফরমেশ মারাক (৬০) চোখে দেখেন না। শারিরীক অবস্থাও ভালো না। টাকা পয়শার অভাবে স্বামীর চিকিৎসা ও কারাতে পারছেন না তিনি। বিমলা রেমা দিনমজুরি করে স্বামীর ভরনপোষণ যুগিয়ে আসছেন। তিনি জানান একদিন কাজে না গেলে সেদিন অনাহারে অর্ধাহারে কাটে তাদের দিন। সরকারি কোনো সাহায্য সহায়তা জুটেনি তাদের ভাগ্যে। কথা হয় মিবন সাংমা, সারতী সাংমা,মহিমা মারাক,মেরিন সাংমাসহ আরো অনেকের সাথে, তারা বলেন আর্থিক সংকটের কারনে তাদের শিশু কিশোররা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাদের অভিযোগ এ গ্রামের বাসিন্দারা পায় না তুলনামূলক ভাবে সরকারি কোনো সাহায্য সহায়তা। ২/৪ জন বয়স্ক ও বিধবা ভাতার কার্ড পেলেও তা পেয়েছে টাকার বিনিময়ে। তাদের দাবি টাকা দিতে না পারায় এগ্রামের দুর্দশা গ্রস্হ সহায়তা পাওয়ার উপযোগী অনেকের ভাগ্যে জুটেনি ভাতা ও ভিজিডি কার্ড। সরেজমিনে অনুসন্ধানে গিয়ে দেখা গেছে এ গ্রামের বাসিন্দাদের রয়েছে গৃহের সমস্যা। হাতে গুনা ৫/১০টি পরিবারের ব্যাতিত প্রায় ঘরগুলো বসবাসের অনুপযোগী।বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাবে গোছল করাসহ নানা কাজে ব্যবহার করতে হয় ঝর্নার পানি। বর্তমানে এ গ্রামের বাসিন্দাদের দুঃখ দুর্দশার যেন শেষ নেই। এরা প্রায় সকল প্রকার নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। বর্তমানে বন্যহাতি ও দারিদ্র্যতার সাথে লড়াই করে টিকে আছে এ গ্রামের বাসিন্দারা। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিলুফা আক্তার বলেন আদিবাসী পল্লীর সমস্যাগুলো সরেজমিনে দেখে কোন পরিবারকে কি সহায়তা দেয়া যায় এব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। শ্রীবরদী উপজেলা ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান প্রাঞ্জল এম সাংমা ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন ওই গ্রামের আদিবাসীদের সমস্যাগুলো সমাধানের লক্ষে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সভা সেমিনারে আলোচনাও হয়েছে। কিন্তু তা কোন কাজে আসেনি। তিনি ওই গ্রামের মানুষের দীর্ঘদিনের দুর্ভোগ লাঘবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সুদৃষ্টি কামনা করেছেন।