রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সমালোচক হিসেবে পরিচিত দেশটির বিরোধী নেতা অ্যালেক্সেই নাভালনির খোঁজ পাওয়া গেছে। তার মুখপাত্র জানিয়েছেন, তিনি জীবিত আছেন এবং তাকে সাইবেরিয়ার একটি পেনাল কলোনি বা কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে।
গতকাল অর্থাৎ ২৫ ডিসেম্বর কিরা ইয়ারমিশ বলেছেন, ‘আমরা অ্যালেক্সেই নাভালনিকে পেয়েছি।’
তিনি আরও জানান, বর্তমানে রাশিয়ার উত্তরাঞ্চলে রয়েছেন তিনি।
এর আগে গত ৬ ডিসেম্বরের পর থেকে নিজের দলের সাথে কোন যোগাযোগ ছিল না নাভালনির। সেদিন তাকে আগের একটি কারাগার থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল।
নাভালনিকে রাশিয়ায় ভ্লাদিমির পুতিনের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী নেতা মনে করা হয়। তিনি ২০২১ সাল থেকে কারাগারে আটক রয়েছেন।
টেলিগ্রাম নামে বার্তা আদান-প্রদানের একটি অ্যাপে মিজ ইয়ারমিশ লেখেন, ‘তার আইনজীবী আজ তার সাথে দেখা করেছে। তিনি ভাল আছেন।’
ইয়ারমিশ বলেছেন, নাভালনিকে রাশিয়ার উত্তরাঞ্চলের স্বায়ত্তশাসিত জেলা ইয়ামালো-নেনেটস এর খার্পে অবস্থিতি আইকে-৩ নামে একটি পেনাল কলোনিতে স্থানান্তর করা হয়েছে।
পেনাল কলোনি হচ্ছে এক ধরনের বসতি যেখানে কারাবাসীদের নির্বাসনে দেয়া হয় এবং তাদের একটি দুর্গম জায়গা বা দ্বীপে রাখার মাধ্যমে বাকি জনগোষ্ঠী থেকে আলাদা করা হয়।
এর আগে নাভালনিকে মস্কো থেকে ২৩৫ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত মেলেখোভো নামে একটি জায়গায় রাখা হয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, নাভালনির খোঁজ পাওয়ার খবরকে তারা স্বাগত জানালেও তার শারীরিক অবস্থা এবং তার আটকাবস্থা নিয়ে ‘গভীরভাবে উদ্বিগ্ন’।
তাকে যে নতুন কারাগারে নেয়া হয়েছে সেটি সংক্ষেপে ‘পোলার উলফ’ বা ‘বরফের হায়েনা’ নামে পরিচিত এবং সেটি পুরো রাশিয়া সবচেয়ে কঠোর জেলখানাগুলোর অন্যতম।
সেখানে থাকা বেশিরভাগ বন্দিই মারাত্মক ধরণের অপরাধের সাথে জড়িত থাকার জন্য অভিযুক্ত, এবং বন্দিদের সেখানে কঠোর শৃঙ্খলার মধ্যে থাকতে হয়।
ইয়ারমিশ বলেন, রাশিয়ার কর্তৃপক্ষ নাভালনিকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে চায় এবং ‘তার জীবনকে যতটা সম্ভব কঠিন করে তুলতে চায়’।
তিনি আরও বলেন, ‘এই কলোনিটি অনেক দূরে, এতে প্রবেশাধিকার পাওয়াটা খুব দুরূহ এবং আইনজীবীদের জন্য সেখানে গিয়ে আলেক্সেইয়ের সাথে দেখা করাটা কঠিন হয়ে পড়বে।’
নাভালনির উপদেষ্টা ইভান ঝাদভ বলেন, নাভালনির অবস্থা প্রমাণ করে যে, ‘রাজনৈতিক বন্দিদের সাথে পুরো ব্যবস্থা কী ধরনের আচরণ করে, এবং তারা তাদের বিচ্ছিন্ন করে দমিয়ে রাখতে চায়।’
গত বেশ কয়েকটি শুনানিতে তাকে আদালতে হাজির হতে না দেখে, বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছিল তার দল।
নাভালনি রাশিয়ার দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে সুনাম কুড়িয়েছেন এবং সামাজিক মাধ্যমে তার তদন্ত সংক্রান্ত ভিডিও গুলো লাখ লাখ মানুষ দেখেছেন।
তাকে একজন ‘অনুপ্রেরণাদায়ক রাজনীতিক’ এবং রাশিয়ার ‘একমাত্র বিরোধী নেতা’ হিসেবে দেখা হয়, যিনি সরকারবিরোধী বিক্ষোভে রাশিয়ার যেকোনো প্রান্ত থেকে ব্যাপক মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাতে সক্ষম।
কিন্তু ২০২০ সালে সাইবেরিয়ায় তাকে বিষপ্রয়োগ করা হয়েছিল, যেটি নার্ভ এজেন্ট ছিল বলে পশ্চিমা ল্যাবরেটরিগুলোতে প্রমাণিত হয়েছে।
তখন তাকে বিদেশে চিকিৎসা দেয়া হয়েছিল। এরপর ২০২১ সালে রাশিয়ায় ফিরলে তাকে সাথে সাথে গ্রেফতার করা হয়।
কে এই অ্যালেক্সেই নাভালনি?
প্রেসিডেন্ট পুতিনের কড়া সমালোচক হিসেবে পরিচিত আলেক্সেই নাভালনি। সরকারের দুর্নীতি প্রকাশ করে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে রাজনীতিতে তার নাম উঠে আসে। তিনি পুতিনের ইউনাইটেড রাশিয়া দলকে উল্লেখ করেছিলেন ‘অসৎ ও চোরেদের দল’ বলে। এ জন্য বেশ কয়েকবার তাকে জেলে যেতে হয়েছে।
পুতিনের ইউনাইটেড রাশিয়া সংসদীয় নির্বাচনে ভোট কারচুপি করেছে বলে প্রতিবাদ করার পর তাকে ২০১১ সালে ১৫ দিনের জন্য গ্রেপ্তার করা হয়।
নাভালনিকে ২০১৩ সালের জুলাইয়ে তছরূপের অভিযোগে অল্পদিনের জন্য জেলে পাঠানো হয়, তবে তিনি বলেন, এই দণ্ডাদেশ ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত।
তিনি ২০১৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হিসাবে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু প্রতারণার দায়ে তিনি আগে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন এই কারণ দেখিয়ে তাকে প্রার্থিতা দেয়া হয়নি।
নাভালনির মতে, এটাও ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত।
এরপর ২০১৯ জুলাইতেনাভালনিকে আবার কারাগারে পাঠানো হয় অনুমোদন না থাকার পরও প্রতিবাদ বিক্ষোভ সংগঠনের জন্য। সেসময় তিনি কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়েন।
চিকিৎসকরা বলেন তার ‘কোনো কিছুর স্পর্শ থেকে চামড়ার প্রদাহ’ হয়েছে। কিন্তুনাভালনি বলেন, তার কোনদিন কোন কিছু থেকে অ্যালার্জি প্রতিক্রিয়া আগে হয়নি।
তার নিজের চিকিৎসক বলেন তিনি ‘কোন বিষাক্ত পদার্থের সংস্পর্শে’ এসেছিলেন। নাভালনিও বলেছিলেন তার ধারণা তাকে বিষ দেয়া হয়েছে।
নাভালনির ওপর ২০১৭ সালে অ্যান্টিসেপটিক রং দিয়ে হামলা চালানো হলে তার ডান চোখ রাসায়নিকে গুরুতরভাবে পুড়ে যায়।
গত বছর মানে ২০২২ সালে তার দুর্নীতি বিরোধী ফাউন্ডেশনকে সরকারিভাবে ‘বিদেশি গুপ্তচর সংস্থা’ বলে ঘোষণা করা হয়। ফলে এই সংস্থার কর্মকাণ্ডের ওপর সরকার কঠোর নজরদারি শুরু করে।
পুতিনের প্রতিপক্ষদের ওপর হামলার ইতিহাস
চলতি বছরের অগাস্টে রাশিয়ায় ভাড়াটে যোদ্ধাদের সংগঠন ওয়াগনার গ্রুপের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোজিন বিমান বিধ্বস্ত হয়ে নিহত হন।
বলা হয়ে থাকে, ক্রেমলিনে গত দুই দশক ধরে ক্ষমতার শীর্ষে থাকা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে প্রিগোজিন বড় চ্যলেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়ার মাত্র দুই মাসের মাথায় বিমান বিধ্বস্তের ঘটনা ঘটে।
বিষয়টি নিয়ে রাশিয়ার ভেতরে এবং বাইরে নানা সন্দেহ তৈরি করে।
সেসময় যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্য থেকে যেসব ইঙ্গিত করা হয় তার অর্থ হচ্ছে – এই বিমান বিধ্বস্তের ঘটনা যে মস্কোর সাজানো তা উড়িয়ে দেয়া যায় না। যদিও এ ইঙ্গিত হলিউডের চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যের মতো মনে হতে পারে।
কারণ এর আগেও প্রেসিডেন্টের প্রতিপক্ষ, সমালোচক বা ভিন্নমত অবলম্বনকারীদের নানাভাবে অপঘাতের শিকার হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
এই তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন ইয়েভগেনি প্রিগোজিন। তার আগেও যারা এ তালিকায় রয়েছেন তাদের মধ্যে নাভালনিও একজন।
এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত নাম সাবেক গুপ্তচর আলেক্সান্ডার লিতভিনেঙ্কো, যিনি ২০০৬ সালে নভেম্বরে হঠাৎ অসুস্থ বোধ করে লন্ডন হাসপাতালে মারা যান। পরে এক তদন্তে জানা যায় সাবেক এই গুপ্তচর পলোনিয়াম ২১০ এর বিষক্রিয়ায় মারা গিয়েছেন, যা খুবই উচ্চমাত্রার একটা রেডিওঅ্যাকটিভ পদার্থ।
এর পর ২০১৫ সালে পুতিনের বিরোধী পক্ষকে নেতৃত্ব দিয়ে আসা সাবেক ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার বরিস নেমেতসভকে মস্কোয় গুলি করে হত্যা করা হয়।
অনেকেই মনে করেন নির্বাসনে থেকেও মস্কোর প্রতিশোধের হাত থেকে বাঁচতে পারেন নি রুশ অলিগার্ক বরিস বেরেজোভস্কি, ২০১৩ সালের মার্চে এই ব্যবসায়ীর মৃতদেহ পাওয়া যায় ইংল্যান্ডের দক্ষিণপূর্বে তার নিজ বাড়ি সারেতে।
কয়েক বছর পর ২০১৮ সালের মার্চে যুক্তরাজ্যে নির্বাসনে থাকা ভিন্নমতাবলম্বী আরেক সাবেক রুশ গুপ্তচর সের্গেই স্ক্রিপাল এবং তার মেয়ে ইউলিয়া মস্কোর হামলার শিকার হন বলে অভিযোগ ওঠে।
ইংলিশ শহর সালিসবুরিতে তাদের ওপর নভিচক বিষ প্রয়োগ করা হয় বলে জানা যায়।
আরেকটি সাড়া জাগানো মৃত্যু ছিল রাশিয়ায় তেলের জায়ান্ট লুকোইলের প্রেসিডেন্ট রাভিল ম্যাগানভ।
তিনি ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে মস্কোয় যে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন সেখানে ‘জানালা দিয়ে পড়ে’ গিয়ে মারা যান, বলে জানিয়েছিল কর্তৃপক্ষ।
এছাড়া পুতিনের সমালোচক সাংবাদিক আনা পোলিতকোভস্কায়াকে মারার আদেশ এবং অর্থ কে বা কারা দিয়েছিল তা রাশিয়ায় কখনোই তদন্ত করা হয়নি।
খবর বিবিসি