দেশের আর্থিক খাত যখন চরম অস্থিরতার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে ঠিক তখনই আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে দেশের ই-কমার্স, এমএলএম ও অনলাইন ব্যবসার নামে শত শত প্রতারণা কাজে যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো। মাল্টিলেভেল মার্কেটিং বা এমএলএম ব্যবসার জন্য বাংলাদেশে আইন আছে। তবে অনুমোদিত কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। তারপরও এ ধরনের ব্যবসা করে কীভাবে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাধারণ জনগণের সাথে প্রতারণা প্রতিষ্ঠানগুলো।১ লাখ টাকা বিনিয়োগে প্রতি মাসের ৭,০০০ – শুরু করে ১১,৫০০ টাকা পর্যন্ত মুনাফা দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। প্রতারিত জন সাধারন মাঝে মধ্যে রাষ্ট্রেীয় গোয়েন্দা সংস্থা অথবা মামলা দায়ের করলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অভিযোগ পরিচালনা করার দৃষ্টান্ত দেখা গেল মূল কারীগররা থেকে যাচ্ছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে । বর্তমানে এদের কার্যক্রম দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশে বসেও পরিচালনা করেছে । এদের কর্মী বাহিনী গ্রামে-গঞ্জে শহরের নিম্ন আয়ের অথবা সাময়িক বেসাময়িক ও অবসারপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের টার্গেট করে অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। অবসার প্রাপ্ত ব্যক্তিগন কিছু একটা অতিরিক্ত আয়ের পথ খুঁজতে গিয়ে যারা জীবনের সঞ্চিত অর্থ দেদারসে তুলে দিচ্ছে এদের কে । প্রতিবছর একেকটি প্রতিষ্ঠান ভেঁঙ্গে বহু প্রতারণা প্রতিষ্ঠানের জন্ম নিচ্ছে ।
এদের ট্রেনিং প্রতারণা মিলন মেলার কেন্দ্রস্থল নামী-দামী হোটেল ও পর্যটন কেন্দ্রগুলো। বিভিন্ন প্রকার পদ-পদবী ও প্রলোভনে পড়ে উঠতি যুবক-যুবতি এমনকি অবসরপ্রাপ্ত কর্মকতা-কর্মচারী ও গৃহবধূ পর্যন্ত তাদের সারা জীবনের সঞ্চিত অর্থ এদের পেছনে বিনিয়োগ করে এখন পথে পথে ঘুড়ে বেড়াচ্ছে। বর্তমানে দেশে এ জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যে সমস্ত ব্যবসার আড়ালে প্রতারণা করছে আমাদের অনুসন্ধানে তা বেরিয়ে এসেছে। আমাদের ধারাবাহিক অনুসন্ধানে এমএলএম নিয়ে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এদের জমকালো ও প্রতারনার বিভিন্ন বীজ।
এমএলএম কি?
এমএলএম বা মাল্টি-লেভেল মার্কেটিং এর বাংলা পরিভাষা হচ্ছে বহুমুখী পণ্য বিপণন পদ্ধতি। মূলত মধ্যস্বত্ত্বভুগীদের বাদ রেখে সরাসরি কাস্টমারের কাছে পণ্য বিক্রয় করে এর লাভের একটা অংশ পুনরায় ক্রেতার কাছে ফেরত দেওয়ার জন্যই এমএলএম এর জন্ম হয়েছিল। বাংলাদেশে জিজিএন বা গ্লোবাল গার্ডিয়ান নেটওয়ার্ক ও টিসি বা টং চং নামের দুটি কোম্পানির মাধ্যমে ১৯৯৮ সালে এমএলএম এর জন্ম হলেও এই পদ্ধতিটি প্রথম আবিষ্কার করেন ১৮৬০ সালে আমেরিকার এক ফেরিওয়ালা যার নাম হেনরি হেইনজ । আর আধুনিক এমএলএম-এর জন্ম হয় ১৯৩৪ সালে। আবিষ্কারকের নাম ড. কার্ল রেইনবর্গ । ১৯৩৪ সালে তিনি কেলিফোর্নিয়া ভিটামিন কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠা করে ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট বিক্রয় শুরু করেন। ১৯৩৯ সালে কোম্পানি তার নাম পরিবর্তন করে নিউটিলাইট প্রডাক্টস কোম্পানি ইনকর্পোরেশন নামকরণ করেন। ১৯৫৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংসদীয় বিলের মাধ্যমে মাত্র ১০ ভোট বেশি পেয়ে এই ব্যবসা আইনগত স্বীকৃতি পেলে এর বিকাশ দ্রুততর হয়। ১৯৯৮ সালে শ্রীলঙ্কার বংশোদ্ভূত নারায়ণ দাস নামের এক ব্যক্তি কানাডা থেকে খবর পান যে দ্রারিদ্রপিরিত বাংলাদেশে এমএলএম এর খুব ভালো সম্ভাবনা আছে। তিনি সেই আশায় বাংলাদেশে দ্রুত বড়লোক হওয়ার পদ্ধতি এমএলএম কোম্পানি খুলে বসলেন। কিছুদিন পর তার কোম্পানি ভেঙ্গে গেলে টং চং নামের আরেকটি কোম্পানি নতুন করে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। তারাও বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় নিউওয়ে প্রাইভেট বাংলাদেশ লি: এবং ডেসটিনি-২০০০ লি: নামের আরো দুইটি কোম্পানির জন্ম হয়। তাদের এই কার্যক্রম দেখে বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে দিন মজুর থেকে শুরু করে সকল শ্রেনীর মানুষ এ পেশায় সম্পৃক্ত হয়ে প্রতারণার স্বীকার হন।
কেন এত এমএলএম কোম্পানীর জন্ম হচ্ছে?
এমএলএম কর্মীরা বিভিন্ন কোম্পানিতে কাজ করতে করতে নিজেরাই কৌশল আয়ত্ত্ব করে ফেলে। তাই মাঠ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে তা কোম্পানিতে আর ফিরিয়ে না দিয়ে নিজেরাই কোম্পানী খুলে বসে।কোন প্রকার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকার কারণে একটি অফিস ও কয়েকজন মিলে একটি ট্রেড লাইসেন্স বানিয়েই নেমে পড়েছে ব্যবসায়। বর্তমানে এ ব্যবসাগুলোর ধরন পাল্টাচ্ছে। এমএলএম প্রতারণার বর্তমানে যে কৌশলগুলো রয়েছে তা আমাদের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে পর্যায় ক্রমে প্রকাশিত হবে ।এমএলএম প্রতারণার ব্যবসা অ্যানালগ থেকে উঠে এসে এখন ডিজিটাল ভার্সনে ছড়িয়ে পড়েছে। একেকটি প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের নিকট থেকে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। পণ্য বিক্রির আড়ালে আবাসন ব্যবসা, হোটেল, টুরিজম, বিটকয়েন, বিভিন্ন প্রকল্প বিনিয়োগের নামে ৩ মাস- ৬ মাসে দিগুন অর্থ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। বাংলাদেশে বর্তমানে কতগুলি প্রতিষ্ঠান এ ব্যবসা করছে তার সুনির্দিষ্ট কোনো তালিকা রাষ্ট্রেয় কোন সংস্থার নিকট নেই। ডাইরেক্ট সেলিং এর নামে বিভিন্ন কোম্পানী অত্যন্ত নিম্ন মানের পন্য উচ্চ মূল্যে বিক্রয় করছে ।যা বাজারের প্রচলিত পণ্যের চেয়ে নিম্নমানের অথচ মূল্য আকাশ ছোঁয়া। কেন নিম্নমানের পণ্যের এত উচ্চ মূল্য তা নিয়ে মাথা ব্যথা নাই কোন রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রনকারী প্রতিষ্ঠানের। এদের আচার-আচারন অত্যন্ত রাষ্ট্রের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো।
কি কি কৌশলে প্রতারনা করছে?
০১. চার্জের নামে প্রতারণা
০২.পিপিসির মাধ্যমে টাকা আত্বসাৎ
০৩. শপিং মলের নামে প্রতারণা
০৪. প্রশিক্ষণের নামে প্রতারণা
০৫. নিম্ন মানের হারবাল পণ্য দিয়ে প্রতারণা
০৬. চড়া দামে পণ্য বিক্রয় করে প্রতারণা
০৭. গাছের ওপর বিনিয়োগের নামে প্রতারণা
০৮. ফ্লাট বিক্রির নামে প্রতারণা
০৯. প্লট বিক্রির নামে প্রতারণা
১০. দশ মাসে দ্বিগুণ টাকা ফেরত দেওয়ার নামে প্রতারণা
১১. সার্ভের নামে প্রতারণা
১২. মাল্টিপারপাসের নামে প্রতারণা
১৩. শেয়ার মার্কেটে ব্যবসার নামে প্রতারণা
১৪. বোর্ড ভাঙ্গা কোম্পানির নামে প্রতারণা
১৫. পামওয়েলের ব্যবসার নামে প্রতারণা
১৬. বাইব্যাক পলিসির নামে প্রতারণা
১৭. ইন্টারনেটে ক্লিকের মাধ্যমে প্রতারণা
কিভাবে>প্রতারিত হয় গ্রাহকেরা:
নেটওয়ার্ক মার্কেটিং এর সামনে অত্যন্ত নিম্নমানের পণ্য অতি মাত্রায় কমিশনের লোভে পড়ে গ্রাহকরা নিজের টাকা দিয়ে পয়েন্ট কেনার নামে পণ্য কিনে। এর পর উক্ত পণ্য সাধারন জনগণের নিকট বিক্রয় করতে গিয়ে সমস্যায় পড়ে ।
একই অবস্থা ইউসিবি চত্বর একাত্তর টাওয়ারে ৫/৬ তলায় অবস্থিত সুনাম ডিজিটাল লিমিটেড। এই একাত্তর টাওয়ারে সুনামসহ প্রায় ১৫টি কোম্পানি রয়েছে একই ভবনে। মিরপুর পল্লবী ওয়েলকাম বিল্ডার্স, উত্তরা এবিসি টাওয়ার সেক্টর ৩ জেনারেল প্রপার্টিজ এন্ড ডেভেলপার্স লিমিটেড (জিপিডিএল), উত্তরার ৭ নম্বর সেক্টর মায়ের দোয়া সিটি লিমিটেড, উত্তরার ৩ নাম্বার সেক্টর মিলিয়ন রিয়েল এস্টেট এন্ড ডেপলপার লিমিটেড,উত্তরার লাভ ফুট প্রোডাক্ট, আল মারজান বিল্ডার্স লিমিটেড, মিরপুর ডিওএইচএস এ পদ্মা রিসোর্ট সহ মিরপুর, উত্তরা, কুড়িল বিশ্বরোড, মালিবাগ, মগবাজার এসব এলাকায় প্রতিদিন নতুন নতুন কোম্পানি অফিস খুলে বসছে।
তাহলে প্রশাসনের নাকের ডগার উপর দিয়ে কিভাবে পণ্য উচ্চমূল্যে বিক্রয় করে । গ্রাহকরা এদের ফাঁদে পড়ে টাকা পয়সা বিনিয়োগ করে পথে পথে ঘুরে বেড়ায় । এ জাতীয় কোম্পানির সংখ্যা শত শত।
অনেক কোম্পানির ইলেকট্রনিক আইটেম নিয়েও কাজ করছে । এদের নিজস্ব কোন ফ্যাক্টরি নাই । শুধুমাত্র ষ্টিকার লাগিয়ে ই এরা পণ্য বাজারজাত করে থাকে। মান নিয়ন্ত্রনে এদের কোন হাত থাকেনা । ইলেকট্রনিক্স পণ্য আফটার সেলস সার্ভিস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । অতএব যে কেউ ব্যবসা করতেই পারে তবে তা হতে হবে নীতিমালার মধ্যে থেকে । তাহলেই গ্রাহকের অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে।