সুস্বাদু মিষ্টি গুড় গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য। আমাদের দেশে মূলত আখ, খেজুর ও তালের রস থেকে গুড় হয় বলেই আমরা জানি।
এর বাইরে শতবছর ধরে আরো এক ধরনের গাছ থেকে হচ্ছে রস ও সুস্বাদু গুড়। গাছটির নাম গোলপাতা। শুধু সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অঞ্চলেই এ গাছ জন্মে। সুন্দরবন অধ্যুষিত এলাকায় গোলপাতা ঘরের ছাউনির অন্যতম উপকরণ। সেই গাছ থেকে পাওয়া রসের গুড় যেমন সুস্বাদু তেমন স্বাস্থ্যকর। বরিশাল বিভাগের দক্ষিণের জেলার পটুয়াখালী। সুন্দরবনঘেঁষা এ জেলার উপকূলীয় উপজেলা কলাপাড়া, যেখানে খাল, নদ-নদীতে নোনা পানির আধিক্য বেশি। ফলে প্রকৃতির নিয়ম ছাড়া এখানে জীববৈচিত্র্যে তেমন একটা পরিবর্তন ঘটে না। এখানাকার নদী ও খালের তীর, এমনকী কৃষিজমির অভ্যন্তরের খালেও বছরের পর বছর ধরে জন্মে চলেছে গোলপাতা গাছ। অনেক জায়গায় এতে ঘন গাছ জন্মেছে যে সেখানে গোলপাতা গাছের বাগানে পরিণত হয়েছে। সুন্দরবনের গণ্ডি ছাড়িয়ে তাই আশপাশের জেলা বা উপজেলার লবণাক্ত মাটিতে তাই জন্মাচ্ছে এ গাছ।
স্থানীয়রা বলছে, প্রাকৃতিক নোনা পানিতে জন্মানো এ গোলপাতা গাছের পাতা-কাণ্ড সবই নোনা। তবে এ গাছের সুস্বাদু ও মিস্টি রস দিয়ে এ অঞ্চলে শত বছর আগ থেকে তৈরি হয় স্বাস্থ্যসম্মত গুড়, যা খেলে ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা যেমন থাকে না, তেমনি রোগ প্রতিরোধের সঙ্গে সঙ্গে এই গুড় বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। তবে বিষয়টি জানে না দেশের অধিকাংশ মানুষ।
যথাযথ সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা পেলে গোলপাতার সঙ্গে সঙ্গে এ গাছের রস দিয়ে তৈরি গুড় স্বাস্থ্যসম্মত ও লাভজনক পণ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে বলে দাবি চাষিদের।
উপকূলীয় অঞ্চল হওয়ায় প্রাকৃতিকভাবেই কলাপাড়া উপজেলায় জন্মেছে অসংখ্য গোলপাতার গাছ, তবে কৃত্রিম উপায়েও বিভিন্ন স্থানে এগুলো লাগানো হচ্ছে। উপজেলার মিঠাগঞ্জ, বালিয়াতলী, ধুলাসার, লতাচাপলী, লালুয়া, ধানখালী, চম্পাপুর, টিয়াখালী, চাকামইয়া ও নীলগঞ্জ ইউনিয়নে গোলপাতা গাছের বহু বাগান রয়েছে। এছাড়া গোলপাতা গাছ নদী ভাঙন রোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করায় উপজেলা বন বিভাগের উদ্যোগে নীলগঞ্জ ও চাকামইয়া ইউনিয়নে বিশাল আকারে গোলপাতা গাছের বাগানও সৃজন করা হয়েছে।
নীলগঞ্জের ঘুটাবাছা গ্রামের হাবিবুর রহমান আকন জানান, মূলত শীত এলে গোলপাতা গাছের রস সংগ্রহ শুরু হয়। বাংলা অগ্রহায়ণ মাসের মাঝামাঝি সময়ে শুরু হয় গোলপাতা গাছ থেকে রস সংগ্রহের কাজ। আর চৈত্র মাসের মাঝামাঝি সময়ে এসে শেষ হয় সাধনার এই কর্মযজ্ঞ। প্রতিদিন দু’বার মাটির কলস ভর্তি করে এ রস সংগ্রহ করা হয়।
গোলবাগান বা বহরের মালিক নিখিল চন্দ্র হালদার জানান, আষাঢ় মাসে গোল গাছের ডগা বা ডাণ্ডিতে হয় গাবনা ফল। পৌষ মাসে ফলসহ স্থানীয় বিভিন্ন নিয়মে ডগা বা ডাণ্ডি দেওয়া হয় নুইয়ে। তবে ওইসময় ডাণ্ডিটি মানুষের পায়ের আলতো লাথি দিয়ে দক্ষতার দোয়ানো বা মেসেজ করে দেওয়া হয়, রসে ভার করার জন্য। প্রায় দুই সপ্তাহ এটা করার পর ডগার মাথা থেকে গাবনা ফলের থোকাটি ধারালো দা দিয়ে কেটে ফেলা হয়। আর কাটা অংশ প্রাকৃতিক নিয়মে তিনদিন শুকিয়ে নেওয়ার পর কয়েকদিন সকাল-বিকেল দুই বেলা আবারো পাতলা করে কাটা হয়।
এরপর ডগা বা ডাণ্ডিতে রস আসা শুরু হলে সংগ্রহের কাজটি শুরু হয়ে যায়। এরপর সেই রস বাগান থেকে সংগ্রহ করে বাড়িতে এনে ভালোভাবে ছেঁকে নেওয়া হয়। পরে বড় পাত্রে তা ঢেলে আগুনে জ্বাল দিতে দিতে তৈরি হয়ে যায় মানসম্মত গুড়।
তিনি জানান, খেজুরের রসের তুলনায় এ রসের ঘনত্ব বেশি হওয়ায় ৮ কলস রসে ১ কলস গুড় হয়, যেখানে খেজুরের রসের ১৬ কলস রসে ১ কলস গুড় হয়। যার বেশ ভালো দামও পাওয়া যায় বর্তমানে।
গোলের রস দিয়ে তৈরি করা গুড়ের চাহিদা রয়েছে উপকূলীয় কলাপাড়াসহ আশপাশের এলাকার মানুষের কাছে। প্রতি সপ্তাহে মঙ্গলবার কলাপাড়া পৌরশহরে বিক্রি হচ্ছে সুস্বাদু এই গুড়। বর্তমানে উপজেলাজুড়ে প্রায় দুইশ পরিবারের জীবন-জীবিকার উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে এই গোলগাছের গুড়। যার মধ্যে অনেক পরিবার তিনপুরুষ ধরে গোলপাতার গাছ থেকেই উপার্জন করে চলছেন।
গোলবাগান বা বহরের মালিকের স্ত্রী কল্পনা রানী হালদার বলেন, গোলগাছ উপকারী, তবে সবাই জানে না। গোলগাছের লম্বা পাতা দিয়ে গ্রামগঞ্জে তৈরি হয় ঘরের ছাউনি, যা টিনের কাজ করে। এর রস দিয়ে তৈরি হচ্ছে সুস্বাদু গুড়, যা খেলে ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আবার লাকড়ি হিসেবে গোলপাতা বাগানের মরে যাওয়া মুথা (ডাটা), ফল ব্যবহার করা হয়।
এদিকে স্থানীয়ভাবে প্রচলন আছে গোলের রস খেলে পেটের কৃমি যেমন দমন হয়, তেমনি কর্মক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে।
এ বিষয়ে কলাপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. চিন্ময় হালদার বলেন, গোলের রস ও রস থেকে তৈরি গুড় সুস্বাদু ও পুষ্টিকর খাবার। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল বিশেষ করে পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলায় এই রস ও গুড় সংগ্রহ করা হয়। স্থানীয় রাখাইন সম্প্রদায় গোলগাছ থেকে রস সংগ্রহ করতো এবং তাদের কাছ থেকে অন্য অধিবাসীরা শিখে এখন গোলের রস ও গুড় সংগ্রহ করে। এই রস ও গুড়ের মধ্যে অনেক পুষ্টিকর সমৃদ্ধ উপদান, বিশেষ করে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ধরনের খনিজ লবণ পাওয়া যায়। যা স্বাস্থ্য ভালো রাখার পাশাপাশি বিভিন্ন রোগব্যাধি থেকে সুরক্ষা রাখতে সহায়তা করে।