মুস্তাকিম নিবিড়ঃ
সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা হিসেবে সারা বিশ্বে সর্বজনীন স্বীকৃত। গণমাধ্যম তথা সাংবাদিকতাকে একটি জাতি কিংবা রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। সংবাদ সংগ্রহ ও প্রকাশ করাই নয় একটি সাংবাদিকের সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি রয়েছে অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য। সততা নিষ্ঠা সাহসিকতার সাথে সমাজের সকল সংগতি অসঙ্গতি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই-বাছাই করে জনগণের কাছে তুলে ধরা একজন সাংবাদিকের নৈতিক দায়িত্ব। অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করে সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ করায় সাংবাদিকরা জনগণের হৃদয়ের মনিকোঠায় অবস্থান করেন। তাই এ মহান পেশার প্রতি জনগণের রয়েছে প্রগাঢ় শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। সাংবাদিক পেশায় যেমনটা ঝুঁকি রয়েছে তেমন রয়েছে সম্মান। কিন্তু সাংবাদিকতার মুখোশ পড়ে নানান অপকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়েছে দেশের যুবক যুবতীদের একটি বৃহৎ অংশ।
সংবাদ কর্মীদের প্রতি সর্বস্তরের জনগণেরই রয়েছে জবাবদিহীতার প্রথা। তাই সমাজের সকল শ্রেণী পেশার মানুষ যখন অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত হয় তখনই সংবাদ কর্মীদের প্রতি তাদের নিজ মনে ভয়ের জন্ম নেয়। সংবাদ মাধ্যমের এসব ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে নানান অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে দেশের যুব সমাজের একটি বৃহৎ অংশ। সারাদেশে প্রায় বিশ হাজার মিডিয়ার ডিক্লিয়ারেশন রয়েছে, এতে কাজ করছে লক্ষ্য লক্ষ্য সংবাদকর্মী। আর এখন ইউটিউব, ফেসবুকের কল্যাণে যে কেউ বনে যাচ্ছে সাংবাদিক, যদিও সাংবাদিক পেশায় আসার আগে সাংবাদিকতার বৈশিষ্ট্য ও নীতি-নৈতিকতার সম্পর্কে বিশদ ধারণা থাকা প্রয়োজন, প্রয়োজন রয়েছে অভিজ্ঞতা অর্জনের ও, গণমাধ্যমের প্রভাব খাটিয়ে লোকাল এরিয়া গুলোতে সাংবাদিক সেজে চাঁদাবাজি, মাদক নিয়ন্ত্রণ, প্রশাসনের সোর্স হয়ে সর্বসাধারণের উপর বল প্রয়োগ করা সহ নানান অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে অনেকেই, এদের বেশিরভাগই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগত যোগ্যতাহীন। অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত বেকাররাই শর্টকাটে অর্থ উপার্জনের জন্য পড়ে নিচ্ছে সাংবাদিকতার মত মহান পেশার মুখোশ। নাম সর্বস্ব গণমাধ্যম কিংবা ইউটিউব চ্যানেল এমনকি স্বনামধন্য স্যাটেলাইট টেলিভিশনেও অর্থের বিনিময় সাংবাদিক হিসেবে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়ার জন্য তারা খরচ করে লক্ষ লক্ষ টাকা, অতঃপর সে টাকা উসুল করে ওরা রাতারাতি অঢেল টাকার মালিক হতে ওইসব তথাকথিত সাংবাদিকরা সাধারণ জনগণকে করে জিম্মি। এদের দাপট প্রভাবের সামনে মূলধারার পেশাদার সাংবাদিক রাও হাঁপিয়ে উঠছে।
এলাকাভিত্তিক অপরাধ চক্রের নিয়ন্ত্রক তারা
দিন দিন বাড়ছে সাংবাদিক রুপি সাংঘাতিকদের দল, মূলধারার সাংবাদিকদের দায়িত্ব অবহেলা ও পাড়া মহল্লার ঘটে যাওয়া সংবাদ প্রকাশে অনিহা থাকার কারণেই মূলত এলাকাভিত্তিক সাংঘাতিকেরা দলে ভারি হচ্ছে। তারা নিজেদের রক্ষা করার জন্য তৈরি করছে এলাকাভিত্তিক প্রেস ক্লাব। সে প্রেসক্লাব তৈরী করছে অন্যের দখলি জমিতে, সেখানে বসেই নিয়ন্ত্রণ করছে মাদক, জুয়া, চাঁদাবাজি। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর ও পেশার মানুষদের তারা করছে জিম্মি। মাদক ব্যবসায়ীদের জন্য সুপারিশ করছে পুলিশ প্রশাসনের কাছে, তার বদলে নিচ্ছে মাসোহারা। সেই ধারা অব্যাহত রাখতে গিয়ে সাংবাদিক রুপী সাংঘাতিকদের মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত হয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে।
রাজউক,ওয়াসা, প্রশাসনের অসৎ কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে ঘুরে তারা
রাজউকের ইন্সপেক্টর নিয়ে ইদানীং বাড়ি বাড়ি হামলা দিচ্ছে কিছু সাংবাদিক রুপি সাংঘাতিক।
কার বাড়ি কয় তালা, পারমিশন রয়েছে কিনা, ডেভিয়েশন আছে কতটুকু, এসব বিষয়ের খোঁজখবর নিয়ে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ইমারত পরিদর্শকদের সাথে নিয়ে বাড়ি বাড়ি হানা দিচ্ছে তারা। বাড়ি নির্মাণে বিধি বিধান না মানলেও টাকার বিনিময়ে পাচ্ছে ছাড়পত্র, পাচ্ছে প্লান, এগুলোর মধ্যস্থতা করছে সে সকল সাংঘাতিকরা, যার বিনিময়ে গুনে নিচ্ছে মোটা অংকের টাকা। যে টাকার ভাগ পাচ্ছে রাজউক ইন্সপেক্টর সহ অন্যান্যরা। ঠিক তেমনি মাদক ব্যবসায়ীদের রক্ষক এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে সেই সকল সাংঘাতিকরা, প্রথমে তারা মাদক বিক্রেতার সাথে সখ্যতা গড়ে, অতঃপর তাদেরকে পুলিশ প্রশাসনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সাপ্তাহিক কিংবা মাসিকভাবে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়, বনিবনা না হলে তুলে দেয় পুলিশ প্রশাসনের হাতে। আবার সেই পুলিশ প্রশাসন থেকে তাদের ছাড়িয়ে ও আনে সে সকল তথাকথিত সাংবাদিকরা। পুলিশ প্রশাসনদের জিম্মি করে তাদের দিয়ে বিভিন্ন সাধারণ জনগণকেও হয়রানি করতে সিদ্ধহস্ত এ সকল ভুঁইফোর সাংবাদিকগন। কেউ কেউ পারিবারিক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়লে এ সকল নামধারী সাংবাদিকদের সাহায্য নিয়ে মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ করিয়ে সামাজিকভাবে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে। সাংঘাতিকদের কথামতো না চললে নেমে আসে ফুটপাতের হকারদের উপর অত্যাচারের স্ট্রিম রুলার, এমনকি মিথ্যা মামলা থেকে শুরু করে জেল-জরিমানা শিকার হতে হয় তাদের। ব্যাটারি চালিত অবৈধ অটো রিক্সা, ফিটনেসহীন যানবহন সহ যোগাযোগ ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অসংগতিকেও প্রশ্রয় দেয় ঐ সকল নামধারী সাংবাদিকরা। সাংবাদিক পরিচয়ধারীদের এসকল অপকর্মের কারণে স্বচ্ছ সাংবাদিকরা আজ মহাবিপদে। জনসাধারণ সেই সকল মুখোশধারী সাংঘাতিকদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে পেশাদার মূলধারা সাংবাদিকদের থেকে।
সাংঘাতিক বানানোর কারিগর যারা
একশ্রেণীর দালাল চক্র রয়েছে যারা বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, টেলিভিশন, মিডিয়ায় সাংবাদিক নিয়োগ দিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকা, এসব ক্ষেত্রে সমাজের নিম্ন শ্রেণীর লোকজনই লুফে নিচ্ছে টাকার বিনিময়ে সাংবাদিক হওয়ার সুযোগ। সেসব মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলো টাকার বিনিময়ে সাংবাদিকতার পরিচয় দিচ্ছে যাদের তাদের নেই কোন সাংবাদিকতার বুনিয়াদী প্রশিক্ষণ, নেই অভিজ্ঞতা, নেই আদর্শ, নেই শিক্ষাগত যোগ্যতা। গলায় কার্ড ঝুলিয়ে কাঁধে ক্যামেরা ও হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে হাজির হচ্ছে যত্রতত্র, কিছু পেলেই হলো, টাকা না দিলেই নিউজ করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সকল জায়গায় করছে চাঁদাবাজি। সেই চাঁদাবাজির ভাগ পাচ্ছে সেসব গণমাধ্যমের মালিক ও নিয়োগ প্রদানকারী দালালেরা। সেসব দালালেরা আবার খুলে বসেছে নাম সর্বস্ব সাংবাদিক সংগঠন, সংগঠনের সদস্য বানিয়ে ওইসব ভুঁই-ফোর সাংবাদিকদের করছে সংঘটিত। তাদের চাঁদার একটি ভাগও নিচ্ছে সেসব ভুঁইফোর সাংবাদিক নেতারা।
সাংঘাতিকে বিব্রত সাংবাদিক সমাজ
ভুঁইফোর সাংবাদিক রুপি সাংঘাতিকদের পাল্লা দিনে দিনে ভারী হচ্ছে, জাতীয় প্রেসক্লাব, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির মত জায়গায় হর হামেশাই ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় কিছু যুবক-যুবতীদের, যাদের হাতে রয়েছে মাইক্রোফোন, কাঁধে রয়েছে ক্যামেরা, গলায় রয়েছে আইডি কার্ড, পকেটে ও ব্যাগে ভিজিটিং কার্ড। সেসব ভিজিটিং কার্ডে রয়েছে একজন সাংবাদিকের দশটির অধিক মিডিয়া হাউজের নাম ও ঠিকানা। এসব ব্যাপারে তাদের কেউ জিজ্ঞেস করলেই তারা বলে বেড়ায় ”আমরা অনেক পত্রপত্রিকায় কাজ করি, আপনারদের কোন সমস্যা হলে বলবেন আমরা সল্ভ করে দেবো”
এদের মধ্যে কেউ কেউ সাংবাদিকের পাশাপাশি মানবাধিকার কর্মীও সেজে বেড়ান। যার মুখ্য উদ্দেশ্য একটাই মানুষকে ভুলভাল বুঝিয়ে অথবা জিম্মি করে অর্থ উপার্জন করা। এদের কারণে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ছে সমাজের সিংহভাগ জনগণ, যার কারণে সাংবাদিকতার মহত্ব ও গুরুত্ব আজ হুমকির মুখে। এদের কারণেই লোকের মুখে মুখে হলুদ সাংবাদিক কিংবা ভুয়া সাংবাদিক অথবা সাংঘাতিক কথাটির প্রচলন শুরু হওয়ায় বিভিন্ন স্থানে বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে সাংবাদিকতার মত মহান পেশায় নিয়োজিত লেখক, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীগণ। তাইতো সাংঘাতিকদের কারণে প্রচন্ড বিব্রতকর পরিস্থিতিতে রয়েছে পেশাজীবী সাংবাদিকগণ।
বড় প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সাংবাদিকদের বাড়ছে অহমিকা
সারাদেশের ছোট বড় বিভিন্ন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান রয়েছে বিশ হাজারেরও বেশি, এতে কর্মরত রয়েছে অনেক পেশাজীবী সাংবাদিক। যাদের বেশির ভাগই সততা ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যাচ্ছে। আবার এ সকল প্রতিষ্ঠানেই নিয়োগ নিচ্ছে সেইসব ভুঁইফোড় সাংবাদিক রুপী সাংঘাতিকরা, করে বেড়াচ্ছে চাঁদাবাজি, মাদক নিয়ন্ত্রণ সহ নানান অপকর্ম। কিন্তু এ সকল অসঙ্গতি থেকে যারা দূরে রয়েছে তাদের হর হামেশাই শুনতে হচ্ছে বড় প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সাংবাদিকদের টিপ্পনী। কোন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক অবস্থা মজবুত এবং ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা থাকলেই তাকে আমরা মূলধারার গণমাধ্যম-মিডিয়া হাউস হিসেবে গণ্য করি। আর এ সকল গণমাধ্যমে যে সকল সাংবাদিকরা কাজ করে তাদের বেশিরভাগই নিজেদেরকে সর্বেসর্বা মনে করে থাকে। তারা বলে বেড়ায় তারা যা লিখে, হাজার জন তা পড়ে। এদের জবাবদিহিতার জন্য তেমন কেউ থাকেনা। গণমাধ্যমের বহুল প্রচারিতার ক্ষমতা বলে এদের কেউ কেউ হয়ে ওঠে প্রচন্ড আত্ম অহংকারী। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় কথিত বড় গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্নীতি ও অনিয়ম ঢেকে রাখতে মাসে মাসে কোটি কোটি টাকা নিজ ভান্ডারে জমা করে। এদের কেউ কেউ স্বর্ণ চোরাচালান, বিদেশে মাদক পাচার, স্মাগলিং, মানি লন্ডারিং, টেন্ডার বাজি, মন্ত্রী আমলাদের নিয়ন্ত্রণ করা সহ আরো বড় বড় অপরাধের সাথে জড়িত। কথায় আছে “যে যত বড়, তার অপরাধ ও ততো বড়” কিন্তু যত দোষ সবই কি ছোট প্রতিষ্ঠানে কাজ করা নন্দ ঘোষের?
মহান পেশা সাংবাদিকতার মুখোশ পরে যে সকল সাংঘাতিকেরা বড়োই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, তাদের মুখোশ উন্মোচন করতে দৈনিক জাতীয় অর্থনীতি পত্রিকার ধারাবাহিক প্রতিবেদন চলমান থাকবে।